সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 722 বার পঠিত
আল-কুরআনুল কারীম :
1- هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ- إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ سَلَامٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ- فَرَاغَ إِلَى أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ- فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ-
(১) ‘তোমার নিকটে ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানদের খবর এসেছে কি? যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, সালাম (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক!) জবাবে সেও বলল, সালাম। (মনে মনে বলল,) এরা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর সে তার স্ত্রীর নিকট গেল এবং (তাদের আপ্যায়নের জন্য) একটা ভূনা বাছুর নিয়ে এল। অতঃপর সেটি তাদের সামনে রাখল। সে বলল, আপনারা কি খাবেন না?’ (যারিয়াত ৫১/২৪-২৭)।
2- وَجَاءَهُ قَوْمُهُ يُهْرَعُونَ إِلَيْهِ وَمِنْ قَبْلُ كَانُوا يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ قَالَ يَاقَوْمِ هَؤُلَاءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ فِي ضَيْفِي أَلَيْسَ مِنْكُمْ رَجُلٌ رَشِيدٌ -
(২) ‘তার কওমের লোকেরা তার দিকে দৌড়ে এল, যারা পূর্ব থেকে কুকর্মে অভ্যস্ত ছিল। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার ঐসব মেয়েরা রয়েছে (যারা তোমাদের স্ত্রী), তারাই তোমাদের জন্য পবিত্র। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর আমাকে আমার মেহমানদের সামনে লজ্জিত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল লোক নেই?’ (হুদ ১১/৭৮)।
3- وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ-
(৩) ‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল। যারা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে (ফাই থেকে) যা দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা নিজেদের মনে কোনরূপ আকাংখা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা নিজেদেরকে হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে বাঁচাতে পেরেছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।
4- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَنْ يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَى طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ-
(৪) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য আহার্য প্রস্ত্ততির অপেক্ষা না করে নবীগৃহে প্রবেশ করো না। তবে যখন তোমাদের ডাকা হবে, তখন প্রবেশ করো। অতঃপর খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়ো। অহেতুক গল্প-গুজবে রত হয়ো না’ (আহযাব ৩৩/৫৩)।
হাদীছে নববী :
(৫) আর আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, আমি খুব ক্ষুধার্ত। তখন তিনি তাঁর সহধর্মিণীদের নিকট পাঠালেন; কিন্তু তিনি তাদের কাছে কিছুই পেলেন না। এরপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, এমন কেউ আছে কি, যে আজ রাতে এ লোকটিকে মেহমানদারী করতে পারে? আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত করবেন। তখন আনছারদের এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আছি, হে আল্লাহর রাসূল! এরপর তিনি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে গেলেন এবং নিজ স্ত্রীকে বললেন, ইনি রাসূল (ছাঃ)-এর মেহমান। কোন জিনিস জমা করে রাখবে না। মহিলা বলল, আল্লাহর কসম! আমার কাছে ছেলে-মেয়েদের খাবার ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি বললেন, ছেলেমেয়েরা রাতের খাবার চাইলে তুমি তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিও, (খাবার নিয়ে) আমার কাছে আসিও, অতঃপর বাতিটি নিভিয়ে দিও। আজ রাতে আমরা না খেয়ে থাকব। সুতরাং মহিলা তা-ই করল। পরদিন সকালে আনছারী ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর খেদমতে আসলেন। তিনি বললেন, অমুক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন অথবা অমুক অমুকের কাজে আল্লাহ হেসেছেন। এরপর আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন, ‘এবং তারা তাদের নিজেদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও’।[1]
6- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الضِّيَافَةُ ثَلاثَةُ أَيَّامٍ فَمَا كَانَ بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ-
(৬) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মেহমানদারি করতে হবে তিন দিন। তার অধিক করা হলে তা দান হিসাবে গণ্য হবে’।[2]
7- عَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم جَاءَ إِلَى سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ فَجَاءَ بِخُبْزٍ وَزَيْتٍ فَأَكَلَ ثُمَّ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُونَ وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الأَبْرَارُ وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ.
(৭) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত একদা নবী করীম (ছাঃ) সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ)-এর বাড়িতে গেলেন। সা‘দ (রাঃ) রুটি ও যাইতুন তৈল আনলেন। তা খাওয়ার পর নবী (ছাঃ) বললেন, তোমাদের নিকট ছায়েমগণ ইফতার করেছে, সৎ লোকেরা তোমাদের খাদ্য খেয়েছে এবং ফিরিশতাগণ তোমার জন্য রহমতের দো‘আ করেছেন’।[3]
8- وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُسْرٍ قَالَ نَزَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى أَبِي فَقَرَّبْنَا إِلَيْهِ طَعَامًا وَوَطْبَةً، فَأَكَلَ مِنْهَا ثُمَّ أُتِيَ بِتَمْرٍ فَكَانَ يَأْكُلُهُ وَيُلْقِي النَّوَى بَيْنَ أُصْبُعَيْهِ وَيَجْمَعُ السَّبَّابَةَ وَالْوُسْطَى، وَفِي رِوَايَةٍ فَجَعَلَ يُلْقِي النَّوَى عَلَى ظَهْرِ أُصْبُعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى، ثُمَّ أُتِيَ بِشَرَابٍ فَشَرِبَهُ، فَقَالَ أَبِي وَأَخَذَ بِلِجَامِ دَابَّتِهِ: ادْعُ اللَّهَ لَنَا فَقَالَ: اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيمَا رَزَقْتَهُمْ وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ. وقال صلى الله عليه وسلم: اللَّهُمَّ! أَطْعِمْ مِنْ أَطْعَمَنِي، وَاسْقِ مَنْ سَقَانِي-
(৮) আবদুল্লাহ ইবনু বুসর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘একদিন রাসূলু (ছাঃ) আমার পিতার কাছে আসলেন। আমরা তাঁর সামনে কিছু খাদ্য ও হায়স ( খেজুর, পনির ও ঘি মিশ্রিত এক জাতীয় মিষ্টান্ন) দিলাম। এর থেকে তিনি কিছু খেলেন, তারপর তাঁর কাছে আরও কিছু খেজুর আনা হলো। তিনি তা খেতে লাগলেন। তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দিয়ে তিনি খেজুরের মধ্যখান দিয়ে বিচি বের করতে লাগলেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলের পিঠের দিক দিয়ে বিচি ফেলতে থাকলেন। অতঃপর তাঁর কাছে কিছু পানীয় আনা হলে তিনি তা পান করলেন। আমার পিতা তাঁর আরোহীর লাগাম ধরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন। তিনি তখন দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে যা দান করেছো তাতে বারাকাত দাও এবং তাদেরকে ক্ষমা করো ও তাদের ওপর অনুগ্রহ কর’ রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! যে আমাকে খাইয়েছে এবং পানাহার করিয়েছে, তাকেও তুমি খাও এবং পান করাও’।[4]
9- وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قُلْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّكَ تَبْعَثُنَا فَنَنْزِلُ بِقَوْمٍ لَا يُقْرُونَنَا، فَمَا تَرَى؟ فَقَالَ لَنَا:إِنْ نَزَلْتُمْ بِقَوْمٍ فَأَمَرُوا لَكُمْ بِمَا يَنْبَغِي لِلضَّيْفِ فَاقْبَلُوا؟ فَانْ لَمْ يَفْعَلُوا فَخُذُوا مِنْهُمْ حَقَّ الضَّيْفِ الَّذِي يَنْبَغِي لَهُمْ-
(৯) উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাদেরকে কোথাও পাঠালে আমরা যদি এমন এক জনপদে গিয়ে পৌঁছি, যারা আমাদের মেহমানদারী করছে না। এমতাবস্থায় আপনার অভিমত কী? তখন তিনি আমাদেরকে বললেন, যদি তোমরা কোন জনপদে অবতরণ করো, আর যদি তারা তা না করে, তবে তাদের নিকট হতে তাদের কর্তব্য পরিমাণ মেহমানের হক আদায় করে নেবে’।[5]
10- عَنْ أَبِى كَرِيمَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةُ الضَّيْفِ حَقٌّ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ فَمَنْ أَصْبَحَ بِفِنَائِهِ فَهُوَ عَلَيْهِ دَيْنٌ إِنْ شَاءَ اقْتَضَى وَإِنْ شَاءَ تَرَكَ-
(১০) আবু কারীম (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, এক রাত মেহমানদারী করা মুসলিমের কর্তব্য। যার আঙ্গিনায় মেহমান নামে, একদিন মেহমানদারী করা তার উপর ঋণ পরিশোধের সমান। সে ইচ্ছা করলে তার এ ঋণ পরিশোধ করবে বা তা ত্যাগ করবে’।[6]
মনীষীদের বক্তব্য :
১. ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর মেহমানদারী করা আবশ্যক, যদি মেহমান কাফেরও হয়’।[7]
২. আবু লাইছ সামরকান্দী বলেন, কোন মেহমান তার মেযবানের ব্যাপারে চারটি জিনিস খেয়াল রাখবেন- ক. মেযবান যেখানে বসাবেন, তিনি সেখানে বসবেন খ. মেহমানদারী যা দিয়েই করাবেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকবেন গ. অনুমিত না নিয়ে খানা থেকে উঠে পড়বেন না ঘ. অবশেষে মেযবানের জন্য বিশেষভাবে দো‘আ করবেন’।[8]
৪. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, মেহমানের আদব হল, মেহমান কখনো খাবারের ব্যাপারে মেযবানের নিকট বিশেষভাবে কোন চেয়ে বসবে না। বরং যে খানাটি সহজ, তা দিয়ে শুরু করা এবং মেযবানের কাজগুলোকে সহজভাবে নেয়া’।[9]
৫. ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, মেহমানদারীর অন্যতম আদব হল মেহমানকে বিদায় জানাতে তাকে বাড়ির বাহির পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া’।[10]
সারবস্ত্ত :
১. মেহমানদারি একটি মহৎ গুণ, যা আত্মীয়তার বন্ধনকে মযবুত করে, বন্ধুত্বকে করে সুদঢ় এবং সামাজিক সৌহার্দ্য সৃষ্টিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে।
২. নবী-রাসূলসহ সকল যুগের সত্যসেবীগণ মেহমান-অতিথিপরায়ণ ছিলেন।
৩. প্রত্যেক মুসলমানের উচিত যথাসাধ্য মেহমানের মেহমানদারী করা।
৫. আনছার-মুহাজিরদের মেহমানদারীর নযীর পৃথিবীর ইতিহাসে মেলা ভার। আর তাঁরাই এ ব্যাপারে আমাদের পূর্বসূরী।
[1]. বুখারী হা/৪৮৮৯।
[2]. মুসনাদে আহমাদ হা/৮০৯৩।
[3].আহমাদ, বায়হাক্বী, ইবনু মাজাহ, আবুদাউদ হা/৩৮৫৪।
[4]. মুসলিম হা/২০৪২ ও ২০৫৫।
[5]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪২৪৫।
[6]. আহমাদ, আদাবুল মুফরাদ, ইবনু মাজাহ, আবুদাউদ হা/৩৭৫০।
[7].মুগনী ১১/৯১ পৃ.।
[8]. ফাতাওয়ায়ে হিন্দী, লাজনায়ে উলামা বেরিয়াসাতে নিযামুদ্দীন বালখী ৫/৩৪৪ পৃ.।
[9].আদাবুশ শারঈয়্যাহ লি ইবনু মুফলেহ ৩/২০৮ পৃ.।
[10].ফাৎহুল বারী ৯/৫২৮ পৃ.।