প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রদত্ত ভাষণ

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 639 বার পঠিত

‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ কর্তৃক আয়োজিত কর্মী সম্মেলন ২০২১- এ আমীরে জামা‘আত

গত ৯ই সেপ্টেম্বর’২১ রাজশাহী নওদাপাড়াস্থ কেন্দ্রীয় মসজিদে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ কর্তৃক আয়োজিত কর্মী সম্মেলন ২০২১- এ আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রদত্ত ভাষণ-

اَلْحَمْدُ لِلهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَي مَنْ لّا نَبِيَّ بَعْدَهُ.

সূরা আলে ইমরানের ১১০নং আয়াতকে সামনে রেখে তিনি বলেন, আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ ও আল্লাহর প্রতি ঈমান। যারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে, কিন্তু নিজেরা আমল করে না, তারা দ্বিমুখী নীতির অধিকারী। এ থেকে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। আর যদি তা না করে তাহ’লে সে মুনাফিক। আল্লাহ কোন মুনাফিককে পসন্দ করেন না। আমি যেটা করি না, সেটা যদি নিষেধ করি। এটাও মুনাফিকী।

আদেশ দেওয়া বিশাল কঠিন কাজ। কিন্তু উপদেশ দেওয়াটা খুব সহজ। ‘আল-আমরু বিল মা‘রুফ’ এই যে আয়াতটি কম বেশী সবাই জানে। তাহ’লে বিশেষ করে যুবকদের জন্য সংগঠন কেন? সংগঠন হচ্ছে একটি বট গাছের মত। সেখানে আট বছরের শিশুও ছায়া পাবে। আবার আশি বছরের বৃদ্ধও সেখানে ছায়া পাবে। তাহ’লে আবার পৃথক ‘যুবসংঘ’ কেন? রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সাত শ্রেণীর মানুষ ক্বিয়ামতের কঠিন দিবসে আল্লাহর ছায়ার নীচে ছায়া পাবে। তার মধ্যে একশ্রেণী হ’ল ঐ যুবক যারা আল্লাহর ইবাদতের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে’ (বুখারী হা/৬৬০)। যুবককে কেন আল্লাহ খাছ করলেন, বৃদ্ধকে বললেন না। আল্লাহ রাসূল এখানে খাছ করে যুবকদের কেন বললেন? সমাজের মূল মেরুদন্ডই হচ্ছে যুবকরা। যুবসমাজ যদি সৎকর্মশীল হয়, সে দেশে অন্যায় কর্ম হ’তে পারে না। যে দেশের যুবশক্তি বিনষ্ট হয়ে যায়, সেদেশে কোনকিছুই টিকবে না। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। রাসূল (ছাঃ) তাঁর কর্মজীবনে নবুঅতের পূর্বে ‘হিলফুল ফুযূল’ গঠন করেছিলেন। নবুঅত প্রাপ্তির পরে তাঁর সঙ্গে যারা ছিলেন তারা প্রায় সবাই যুবক। এমনই একজন যুবক আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা কাফেরদের বিরুদ্ধে কবিতা পাঠ করছিলেন। ওমর ফারুক বললেন, এই আব্দুল্লাহ! তুমি তাওয়াফরত অবস্থায় কবিতা পাঠ করছ? রাসূল বললেন, থাম ওমর, আব্দুল্লাহকে কবিতা পাঠ করতে দাও। কেননা তার একেকটি কবিতা কাফেরদের জন্য তীর বর্ষণের সমতুল্য। ওকে বলতে দাও।

আজকের আধুনিক বিশ্ব যে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য দেখছে তা একজন যুবক আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার সিদ্ধান্তের ফসল। তখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য খ্রিষ্টান বাইজানটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আয়ত্ত্বাধীন ছিল। তদানিন্তনকালের বিশ্ববিজয়ী রোমক সাম্রাজ্যের দুই লক্ষ চল্লিশ হাযার সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাযার সৈন্যের যুদ্ধ হবে, এটা কিভাবে সম্ভব? মুরুববীরা সিদ্ধান্তে বসে গেলেন, কি করা যায়?  মজলিসের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হ’তে যাচ্ছিল যে, যুদ্ধ না করেই ফিরে যাবে। অথবা কাউকে পাঠাবে মদীনায়, পরবর্তীতে আল্লাহর রাসূল কি নির্দেশ দেয়। ইতিমধ্যে যুবক আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ছুটে এলেন, হে মুরুববীরা! আপনারা কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? তাদের জবাব শুনে সে বলল, আমরা এখানে কি জন্য এসেছি, হয় যুদ্ধে জয়লাভ, নয়তো শাহাদৎ। তারা বলল, হ্যাঁ, কথা ঠিক। তাই যদি হয় যুদ্ধ জয় হবে আল্লাহর হুকুমে। চলুন! যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি আল্লাহর উপর তায়াক্কুল করে। হয় বিজয়ী হব অথবা শহীদ হব, দু’টিই আমাদের লাভ। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, আল্লাহ পাক তাঁর দো‘আ কবুল করলেন। মাত্র ১২জন শহীদের বিনিময়ে দুই লক্ষ চল্লিশ হাযার সৈন্য কোথায় পালিয়ে গেল, তার কোন হদিস নাই। ঐ দিন একজন যুবকের একটা কথায় পুরা মধ্যপ্রাচ্য পরিবর্তন হয়ে গেছে।

বাংলার যমীনে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র এরকম মুজাহিদ বান্দা তৈরী হয়ে গেলে, প্রত্যেক যেলায় একটা করে থাকলে পুরা দেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ঐ যুবকদের আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। সব জায়গায় ভীরু-কাপুরুষদের মেলা। এক পা হাটলে তিন পা পিছাই। এসব দিয়ে কোন কাজ হবে না। আমার এক ঠিকানা ভূপৃষ্ঠে, আরেক ঠিকানা হচ্ছে চিরস্থহায়ী জান্নাত। আর এর মাঝখানে কিছুই নাই। যতদিন বেঁচে আছি পরকালের পাথেয় সঞ্চয় করার জন্যই বাঁচব। আমার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ ও পয়সা স্রেফ জান্নাতের জন্য ব্যয় হবে। তোমাদের মনের কথা বলতে পারবো না, জিজ্ঞাসা করছি শুধু আল্লাহকে সাক্ষী রাখার জন্য, তোমরা কি এরকম যুবক হ’তে পারবে? (সমস্বরে সবাই- ইনশাআল্লাহ)।

দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কাছে কখনো মাথা নত করবে না। বাতিলের সাথে কোন আপোস নাই। কুরআন ও হাদীছ যেখানে, আমার জীবন সেখানে। আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর একটা হাদীছের জন্য দশবার মরতে প্রস্ত্তত আছি। এই মেজায যদি তোমাদের তৈরী হয়ে যায়, ইনশাআল্লাহ দুনিয়ায় তোমাদের কেউ ঠেকাতে পারবে না। কোন শক্তি তোমাকে দমাতে পারবে না, নির্মূল করতে পারবে না। ১৮ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৮টি যুবক লাগবে। সারা বাংলা পরিবর্তন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

খবরদার! দুনিয়াবী কোন স্বার্থ নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়ো না। দুনিয়া সবচেয়ে ক্ষতিকর, আর শয়তান লেগে আছে ধ্বংস করার জন্য।

বিরোধীরা ফতোয়া দিয়ে বায়‘আত নিয়ে বির্তক সৃষ্টি করে আমাদের মধ্য থেকে ইসলামের মূল স্পিরিট ধ্বংস করছে। বাংলার যমীনে শুধু ইমারত ও বায়‘আতের দীক্ষা আমাদের সংগঠনেই রয়েছে। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ এই মৃত সুন্নাতকে যিন্দা করার জন্য ইনশাআল্লাহ শত শহীদের ছওয়াব পেয়ে যাবে। এই মেজায যেন তোমাদের থাকে। আমরা কারো নামে শপথ করিনি, আল্লাহর নামে বায়‘আত করেছি। ব্যাস খালাস!

প্রতিটা কাজ করার আগে আমাকে চিন্তা করতে হবে যে, এই কাজে গুনাহ আছে না নেকী আছে। নেকী থাকে করবো আর কোন ব্যাখ্যার দরকার নেই। ফতোয়া দিয়ে মানুষের ক্ষতি হয়ে গেলে, সে ফতোয়ায় লাভ কী? এজন্য করণীয় সম্পর্কে তোমাদের গঠনতন্ত্র, ইহতিসাবে সবই বলা আছে।

আমি যুবসংঘে’র প্রতিটি কর্মী ভাইকে বলল, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন? বইটি অন্তত দুই মাসে একবার শেষ করবে। আর থিসিসটা তিন, চার মাসের মধ্যে একবার শেষ করবে। যুবসংঘের ছেলেদের ব্রেন ভালো, বয়স কম তোমাদের পড়ার বয়স, আর তোমরা যদি বই না পড় এবং মুভমেন্টে থাক, তাহ’লে কিছুই বুঝতে পারবে না। আর আমাদের পূর্বসুরী মুরুববীদের কথা যদি তোমরা না জানো, আগামীতে গিয়ে কোন কূল কিনারা পাবেনা।

গত জুম‘আয় বলেছিলাম। আহলেহাদীছ গ্রামগুলোতে গিয়ে ২টা কুরআনের আয়াত পড়ে ২মিনিট দারস দিলে তোমাকে তাড়িয়ে দিবে, এমন কোন মুসলমানের বাচ্চা নাই। মসজিদ ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোল। আর যদি তা না পার, তবে মসজিদ ভিত্তিক সংগঠনের কোন প্রয়োজন নেই। তোমার বাড়িতে যদি তিনটা লোক থাকে, তাহ’লে তাদেরকে নিয়ে সংগঠন কর। সংগঠনবিহীন জীবন যেন কারো না থাকে। সারা দেশে, গ্রামে গ্রামে আহলেহাদীছ আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক, সে কামনা তোমাদের নেই? ছড়াবে কে? নিজেকে যেতে হবে না? একে অপরের ভুল ধরে সময় নষ্ট করো না। যে নিজে যত বেশী দাওয়াত দিতে পারবে, তত বেশী নেকী পাবে। নেকীর পাগল হও। পাগলামী ছাড়া কোন কিছু অর্জন হয় না। কথায় কথায় যারা হিসাব করে পা ফেলে, তাদের দ্বারা কিছু হয় না। আমীরের নির্দেশ- দাওয়াত দিতে হবে, কি করে দিবে তা জানি না। মনে রাখবে, যে পা ফেলে না, তার কি হোঁচট লাগে? সে তো হাটে না, তাহ’লে কি করে হোঁচট লাগবে? আর যে ঘরে বসে থাকে, তার কিছুই হয় না।

আমার দাবী তোমাদের কাছে- আহলেহাদীছ আন্দোলনের বাহক হিসাবে দাওয়াত মাঠে, ঘাটে, হাটে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিবে। এজন্য থিসিসের মধ্যে বাংলায় মাওলানা বেলায়েত আলীর দাওয়াতী চ্যাপ্টারটা পড়ে দেখ।

তিনি যখন কোথাও যেতেন, তার দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগত। যদি মাঠে কোন কৃষক লাঙ্গল চাষ করত, তার কাছে দাওয়াত দিতেন। যদি কোন বাযার অতিক্রম করতেন, সেখানে দাওয়াত দিতেন। যদি দোকান পেতেন, সেখানে দাওয়াত দিতেন। আর এভাবে দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে ২ মাস সময় লেগে যেত। আমরা এই সমস্ত মনীষীদের দাওয়াতী ফসল।

আমার আববা মাওলানা আহমাদ আলীর জীবনী পড়ে দেখ। তিনি জোঁকের কামড় কিভাবে খেয়েছেন, তিনি গামছা নিয়ে যেতেন এবং পানিতে সাঁতার দিয়ে ঐ পাড়ে গিয়ে আবার কাপড় পরতেন। আর লবণ নিয়ে যেতেন জোঁক ছাড়াবার জন্য। জোঁকের কামড় খেয়ে পা গুলো লাল হয়ে যেত। আববা জোঁকের কামড় খেয়ে দাওয়াত দিয়েছেন বলেই সাতক্ষীরার আশাশুনি উপযেলা ও বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে কালাবগী-সুতারখালী গ্রামগুলি এখন আহলেহাদীছ।

এই সমস্ত মুরুববীরা দাওয়াতী কাজ করেছে বলে আমরা সেখানে সংগঠন করছি। আমরা তো বিমান ছাড়া চলি না; মাইক্রো ছাড়া চলি না। আমরা তাদের সমতুল্য হতে পারব না। আর আমাদের যুগ ডিজিটাল যুগ। আমরা ইচ্ছা করলে ঘরে বসে এখন দাওয়াত দিতে পারি। তখন সে সুযোগ ছিল না। এক মোবাইলে আপনি দাওয়াত দিতে পারেন। অনলাইনে আপনি দাওয়াত দিতে পারেন। কিছু দিন আগে যুবসংঘে’র ভার্চুয়াল বেশ কিছু বড় প্রোগ্রামও হয়েছে।

‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ হবে আদর্শ মডেল। এক জঙ্গলে বাঘ আর ছাগল এক সাথে মিটিং করতে পারে? বসার আগে খেয়ে ফেলে দিবে। তাই না? ঐ দুইটা পশু কিন্তু বৈশিষ্ট্যগতভাবে আলাদা। সে যুগে কোন ওহাবী যদি গ্রামে ঢুকতে তাহ’লে তো ঐ গ্রামে ভয়ে কম্পন শুরু হয়ে যেত। তার কারণ হচ্ছে ওহাবীরা শুধু ভুল ধরে। মেয়েরা সব পালিয়ে ঘরে ঢুকত। তখন কোন পর্দা ছিল না। বাড়ির পাশে কোন প্রাচীর নেই। কেউ বাড়িতে দাওয়াত দিতে আসলে আববা বলতেন, বাড়িতে পর্দা আছে? যে বাড়িতে পর্দা না থাকত, তাকে বলতেন, তাহ’লে পর্দা বানাও, তারপর এসো। তখনকার দিন মানুষের পায়খানা ঘর ছিল না। ঝাড়ে, বাগানে গিয়ে মানুষ প্রয়োজন সারতো। কলা গাছের পাতা দিয়ে পর্দার ব্যবস্থা হলে, আববার কাছে রিপোর্ট দিলে তারপর আববা যেতেন। আর এ সমস্ত কাজের জন্য আহলেহাদীছ সমাজটা গড়ে উঠেছে।

রাফঊল  ইয়াদাইন, জোরে আমীন বললেই শুধু আহলেহাদীছ হওয়া যায় না। শুধু এদিয়ে জান্নাত পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, আমাদের নবী কিভাবে পায়খানা করতেন, তাও শিক্ষা দিয়েছেন। পূর্ব-পশ্চিম বসার জ্ঞানও তিনি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের যুবসংঘের ছেলেরা যেখানেই থাকবে, সেখানেই প্রতিটি পদে পদে এইভাবে সংষ্কার করবে।

দাড়ি কাটা লোকটা কোন দলের লোক চেনা যায়। দাড়ি ছাটা ওটা কোন দলের লোক চেনা যায়। আর ‘যুবসংঘে’র ছেলেদেরকে দাড়ি কাটা-ছাটা কোনটাই চলবে না। আবার টুপি দেখলেও চেনা যায়, চেনা যায় না? কয় কলি? সাবধান অন্যদের অনুকরণ করো না। তোমার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল থাকো। তাহ’লে জীবনটা স্বার্থক হবে। আল্লাহর ইবাদতে যৌবনকে গড়ে তোলো। তাহ’লে ইহকালে পরকালে তুমি হবে শ্রেষ্ঠ যুবক। শ্রেষ্ঠ উম্মতের দলভুক্ত হ’তে পারবে ইনশাআল্লাহ। আজকে তুমি যুবক, কাল তোমার সন্তান তোমাকে দেখে শিখবে। আর বাবা যদি সঠিকভাবে গড়ে না ওঠে, তাহ’লে ঐ সন্তানের অবস্থা কি হবে?

আমরা যখন যুবসংঘ শুরু করেছিলাম, তখন আমার সাথীরা সবাই ছিল যুবক। এখন অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আবার কেউবা অসুস্থ। আল্লাহ আমাকে এখনও সুস্থ রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ। স্মৃতিচারণ করলে নিজের কাছে মনে হয়, অনেক বয়স হয়ে গেছে। আর বাঁচার প্রয়োজন নাই। তবুও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তোমাদের কাছে আমার দাবী, যতক্ষণ নিশ্বাস আছে ততক্ষণ পরকালের পাথেয় হাসিল করো। তোমার দ্বারা একজন মানুষও যদি হেদায়াত পায়, তাহ’লে সেটাই তোমার জান্নাতে যাওয়ার অসীলা হয়ে যাবে।

যত পারো বই বিতরণ করো। আমরা যখন যুবসংঘ শুরু করি, তখন আমাদের কোন বই ছিল না। স্রেফ আমরা যবান দিয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করি। কেউ তো আমাদের চিনতো না। ১৯৭৯ সালের জুলাইতে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ বইটা লিখলাম। তখন এত বাধা ছিল যে, আমি প্রথমে খুৎবা দিতে গিয়েছিলাম ঢাকার ধামরাইতে। আমাকে দেখে ইমাম ১২:৩০-এর খুৎবা ১২:২০ খুৎবায় শুরু করে দেয়। শুরুতেই এই হিংসা, সেটাও আহলেহাদীছ মসজিদে, যেখানে ফাযিল মাদরাসা আছে। তাদের ধারণা, এই ছেলে খুৎবায় উঠলে সব শেষ করে দিবে। তাহ’লে বুঝ, তারা কেমন আহলেহাদীছ, আর আমি কেমন আহলেহাদীছ! লাভ কিছুই হলো না। আমি মিসকীন বসে আছি, মুছল্লীরা সবাই ডেকে নিয়ে সামনে নিয়ে চলে গেল। আমার বক্তব্য হয়ে গেল ২ ঘন্টা, একটা মুছল্লীও ওঠেনি। প্রথম থেকে বাধা শুরু হয়েছে, ঘরের বাধা, রাষ্ট্রের বাধা। সব বাধা ডিঙ্গিয়ে এখন সব ভালো আলহামদুলিল্লাহ। পরবর্তী সময় যেন আল্লাহ তোমাদের বাধাগ্রস্ত না করেন। তবে সত্যি কথা কি, যদি বাধা না আসে তাহলে কাজে কোন গতিও আসে না। এজন্য সরকার ছোট পাথরের পরিবর্তে রাস্তায় বড় বড় পাথর দিয়ে রাস্তা বানাচ্ছে। যাতে করে ড্রাইভার রাস্তায় ঘুমিয়ে না পড়ে। তোমরা হুটরা রাস্তায় চল, প্লেইন রাস্তায় চলো না। তা না হলে তোমরাও ঘুমিয়ে পড়বে। বাধাবিঘ্ন হওয়ার দরকার আছে, না হলে আগাবে কিভাবে? আমরা যখন কারাগারে গেলাম, তখন মিছিলে মিছিলে সারা দেশ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এখন আর মিছিল হয় না। আবার আর একবার যাওয়া লাগবে, তাহ’লে আবার সবাই চাঙ্গা হবে।

বছরে তোমরা একবার ইজতেমাতে আস। আর আমি বলব নিজ নিজ যেলাতে জালসা করা বাদ দাও। প্রত্যেক মসজিদে মসজিদে তা‘লীমী বৈঠক করো। তাবলীগ জামা‘আত কোন জালসা করে? ওদের লোক এত বেশী কেন? তোমরা বাড়ির মসজিদ এবং পাশের অন্য আরেকটি মসজিদে তা‘লীমী বৈঠক কর। মসজিদে লোক থাক আর না থাক তোমরা তা‘লীম দাও। তোমরা আমার সাথে ওয়াদা করো।

ইংল্যান্ডের এক প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে কথাই বলতে পারেনি। জনগণ বলল, এ কোথাকার কে? যে কথাই বলতে পারে না? লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে গেল। সে বাড়িতে খেজুর গাছের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিল। শ্রোতা হ’ল খেজুর গাছ আর সে নিজে হ’ল বক্তা। অবশেষে সে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়ে গেল। তোমরাও এভাবে ভাল বক্তা হওয়ার চেষ্টা করবে। জাকির নায়েক কথা বলতে গিয়ে তোতলামি করত। আর এখন সে পৃথিবীর সেরা বক্তা।

উপমহাদেশের এমনই একজন আলেম আব্দুর রউফ ঝান্ডানগরী (নেপাল) প্রথম জীবনে ছাত্র হিসাবে দূর্বল ছিলেন। তার পিতা চৌদ্দ বিঘা জমির উপরে ‘সিরাজুল উলূম’ মাদরাসা খুলেছেন। ছেলের মাথায় কিছু নাই। তিনি ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য ভারতের কসাই খ্যাত একজন আলেমকে ভাড়া করে নিয়ে আসলেন এবং তিনি তাকে তার ছেলেকে পিটিয়ে একজন যোগ্য আলেম বানানোর কাজ দিলেন। এই লোকটিই ক্লাসে ফাস্ট ছাড়া আর সেকেন্ড হননি। শুধু তাই নয় তিনি পরবর্তীতে ‘খতীবে হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতে দিল্লী রহমানিয়া মাদরাসায় প্রতি বছর একটা করে উপস্থিত বক্তৃতার প্রতিযোগিতা হত। সারা ভারতের ভালো মাদরাসায় ভালো ছাত্ররা সেখানে যেত এবং সেখানে ভারতের সেরা সেরা আলেমরা উপস্থিত থাকতেন। বিশেষকরে ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, আল্লামা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী মত বিখ্যাত আহলেহাদীছ আলেমরা সেখানে উপস্থিত থাকতেন। বিষয় ছিল ‘নবীজীর জীবনী’ এবং সময় পাঁচ মিনিট। কিন্তু তার বেলায় সময় কমিয়ে দুই মিনিট করা হ’ল। এই দুই মিনিটেই তিনি মজলিস একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এবং শ্রেষ্ঠ বক্তার খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।

‘যুবসংঘে’র ছেলেদের বলব, তোমরা আমাদের বইগুলো ভাল করে পড়। মনে রেখ, যুবসংঘ একটি ইউনিভার্সিটি আর ‘যুবসংঘে’র বইগুলো পড়লে তা হবে দশবার ভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নেওয়ার সমতুল্য। দশবার কামেল পাশ করেও তা পাবেনা। যুবসংঘে’র গঠনতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি, ইহতিসাব ভালো করে পড়, সেখানে সব বলে দেওয়া আছে, পড়লে তোমরা সব নিজেরাই পারবে।

‘যুবসংঘে’র প্রতিটি কর্মীকে দশ মিনিটের বক্তব্যকে দুই মিনিটেই ফুটিয়ে তুলতে হবে। যেমনভাবে সূরা আছরের শিক্ষা দশ মিনিটেও বলা যায় আবার দুই মিনিটেও বলা যায়। তাহ’লেই তোমরা নিশ্চয়ই সম্মানিত হবে ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে বলব, ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ জান্নাতের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। নিজ নিজ এলাকায়, নিজ নিজ গ্রামে, নিজ নিজ শহরে যেন যুবসংঘে’র ছেলেরা মডেল হয়ে গড়ে ওঠে। তোমাদেরকে সন্ত্রাসী, জঙ্গী আর কত কিছু বলবে মানুষ, তার কোন ইয়ত্তা নাই। কোন কিছু বলে তোমাদের ঠেকাতে পারবে না। এযাবৎ কেউ পারে নাই, খুব চেষ্টা করেছে। ইনশাআল্লাহ আগামীতেও পারবে না, যদি তোমরা আদর্শের উপরে টিকে থাকতে পারো। আহলেহাদীছ যুবসংঘ কখনো জঙ্গী বা সন্ত্রাসী কিছুই নয়। আমরা সর্বদা মধ্যপন্থী। আমরা শুধু মানুষকে ‘ন্যায়ের আদেশ করবো আর অন্যায় থেকে নিষেধ করবো’। নিষেধ করলে গা জ্বালা করে, সবার গা যত জ্বলে জ্বলুক, আমাকে বলতে দিতে হবে। আমি জেলে গেল তো আর সবাই বাহিরে থাকবে। অতএব চিন্তার কারণ নেই।

একটি কথা সর্বদা কর্মীরা মনে রাখবে ‘যত বেশী সফর করবে তত বেশী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে’। সফর নাই, আন্দোলন নাই। যতই তুমি বই লেখে ডিপো হও, লাভ নাই।

আমি যদি ‘যুবসংঘ’ হই, তাহ’লে আপনি ‘যুবসংঘ’, মুরুববীরাও ‘যুবসংঘ’। কিসের প্রতিষ্ঠাতা, কিসের আমীর, কিছুই না। আমি আল্লাহর গোলাম, খাদেম।

‘যুবসংঘে’র প্রতেক্যটা কর্মীকে নিরহংকার হ’তে হবে। অলসতা, বিলাসিতা বাদ দিতে হবে। হক কথা বলতে হবে সুন্দর আচরণ দিয়ে, বদমেজাযী হওয়া যাবে না। আক্বীদা থাকবে দৃঢ়, আচরণ থাকবে নরম। ইনশাআল্লাহ আহলেহাদীছ ‘যুবসংঘে’র বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। আল্লাহ পাক যেন আমাদের সবাইকে তাঁর জান্নাতের জন্য কবুল করে নিন। আর আমাদের মা বোনদেরকে তার পথে ধরে রাখার তাওফীক দান করুন-আমীন।

‘যুবসংঘে’র ছেলেদের আমার আর একটা ছোট্ট নছীহত, যা ‘যুবসংঘে’র জন্মলগ্নে মাসিক রিপোর্টে বলা ছিল। সেটি হ’ল আপনার শাখায় মক্তব আছে কি না? এখন বলছি, সোনামণি মাদরাসা আছে কি না? প্রত্যেক শাখার মসজিদে একটি করে মক্তব চালু করো। ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ডে’র প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম ক্লাসের বইগুলো সেখানে পড়াও। মানুষ বেতন দিক আর না দিক। একদিন সেটিই একেকটি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের’ ঘাঁটিতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।

তোমাদের হাতে গড়া ঐ ছেলে যদি আগামী দিনে  বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টও তবুও হয়, তার আক্বীদা নষ্ট হবে না ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে আমি আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মুরুববী হন আর সন্তান হন সবাই মৃত্যুকে সামনে নিয়ে কাজ করুন। সেদিন জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের এক ভাই বসে বক্তৃতা দিতে দিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। উর্দূ কবি বলেছেন,

‘মৃত্যু আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। মৃত্যুর ঘন্টা যে কোন সময় তোমার আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে। যে কোন সময় জীবনটা চলে যাবে’। অতএব সাবধান!

যুবকরা আমাদের প্রথম টার্গেট। যুবশক্তি আসল শক্তি। যুবক নাই তো সমাজ নাই। যুবসংঘ, সোনামণি, ‘আল আওন’ সবাইকে বলব, তোমরা একযোগে কাজ করে যাও। আল-‘আওনকে সাধ্যমত সবাই সহযোগিতা কর।

আমরা শুধু রাফঊল ইয়াদাইন, জোরে আমীন বলার কথা বলি না। বরং সমাজের সার্বিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করি। বিষয়গুলো আপনারা খেয়াল রাখবেন। সমাজের সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে দিবেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের স্বার্থে, পরকালের স্বার্থে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করার তাওফীক দান করুন-আমীন!



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও