দ্বীনী জ্ঞানের মর্যাদা (৪র্থ কিস্তি)

লিলবর আল-বারাদী 1749 বার পঠিত

৮. শিশু বক্তাদের নিকট থেকে জ্ঞান আহরণে বিরত থাকা : জ্ঞান কার নিকট হ’তে গ্রহণ করা হচ্ছে, তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা ইলম বা জ্ঞান হ’ল দ্বীনের স্বরূপ। যেখানে দ্বীন নেই, সেখানে জ্ঞানও নেই। মুহাম্মাদ বিন সিরীন (রাঃ) বলেন, إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ ‘নিশ্চয়ই এ জ্ঞান দ্বীন স্বরূপ। সুতরাং তোমরা লক্ষ্য রাখবে কার নিকট হ’তে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ’।[1]

দ্বীনের নছীহত কাদের থেকে গ্রহণীয় সে সম্পর্কে আব্দুল্ললাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘দ্বীন ইসলাম তখন নষ্ট হয়ে যাবে, যখন মানুষ ছোটদের নিকট থেকে ইলম নিবে এবং বড়দের বিরোধিতা করবে। অথচ মানুষের সংশোধন তখন হবে যখন ইলম আসবে বড়দের থেকে, আর ছোটরা তাদের অনুসরণ করবে’।[2]

আব্দুল্ললাহ ইবন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘মানুষ ততদিন কল্যাণের ওপর থাকবে, যতদিন তাদের কাছে ইলম আসবে কিবার তথা বড়দের থেকে। যখনই তাদের কাছে ছোটদের থেকে ইলম আসবে, তখন তারা ধ্বংস হবে’।[3] ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রহিঃ) বলেন,

 وَقَدْ قَالَ بَعْضُ النَّاسِ: أَكْثَرُ مَا يُفْسِدُ الدُّنْيَا: نِصْفٌ مُتَكَلِّمٌ وَنِصْفٌ مُتَفَقِّهٌ وَنِصْفٌ مُتَطَبِّبٌ وَنِصْفٌ نَحْوِيٌّ هَذَا يُفْسِدُ الْأَدْيَانَ وَهَذَا يُفْسِدُ الْبُلْدَانَ وَهَذَا يُفْسِدُ الْأَبْدَانَ وَهَذَا يُفْسِدُ اللِّسَانَ.

‘দুনিয়াকে সবচেয়ে বেশী ধ্বংস করেছে আধা বক্তা, আধা ফাক্বীহ (আলিম), আধা ডাক্তার আর আধা ভাষাবিদ। এদের মধ্যে আধা বক্তা দ্বীনকে ধ্বংস করে, আধা ফকীহ দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করে, আধা ডাক্তার মানুষের শরীরকে নিঃশেষ করে আর আধা ভাষাবিদ ভাষাকে বিনষ্ট করে’।[4]

তবে শিশু বয়সে কোন কথা জেনে থাকলে তা পরবর্তীতে বর্ণনা করলে তা গ্রহণীয় হবে। কিন্তু জানার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর সর্বনিমণ বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। মাহমূদ ইবনুর রাবী (রাঃ) বলেন, عَقَلْتُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم مَجَّةً مَجَّهَا فِى وَجْهِى وَأَنَا ابْنُ خَمْسِ سِنِينَ مِنْ دَلْوٍ ‘আমার মনে আছে, রাসূল (ছাঃ) একবার বালতি থেকে পানি নিয়ে আমার মুখমন্ডলে কুলি করে দিয়েছিলেন, তখন আমি ছিলাম পাঁচ বছরের বালক’।[5]

৯. সালাফ বিদ্বানদের নিকটে জ্ঞানার্জন করা :

সালাফগণ জ্ঞানের সঠিক ধারক ও বাহক। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, ‘প্রতিটা দলের মাঝেই হক্ব-বাতিল আছে। সুতরাং কর্তব্য হ’ল তারা যে হক্ব কথা বলবে, তাতে একমত হওয়া আর যে বাতিল কথা বলবে, তা পরিত্যাগ করা। আল্ললাহ যার জন্য এ পথটুকু খুলে দিবেন, তার জন্য ইলম ও দ্বীনের সমস্ত দরজা উন্মোচিত হয়ে যাবে, এ দুইয়ের ক্ষেত্রে সকল উপকরণ সহজ করে দেওয়া হবে। আর আল্ললাহর কাছেই সাহায্য চাই’।[6]

বিদ‘আতিদের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করা নিষেধ। শায়েখ রাবী’ বিন হাদী উমাইর আল মাদখালী বলেন, الجهل أفضل من أخذ العلم عن أهل البدع، لايطلب العلم منهم ولايطلب عليهم فوالله لأن يبقى جاهلا سليم العقل والفطرة والقلب خير له من أن يتعلم من صاحب الهوى فتفسد عقيدته ويفسد منهجه. ‘বিদ‘আতীদের থেকে ইলম গ্রহণ করার চেয়ে অজ্ঞতা অধিক উত্তম। বিদ‘আতীদের থেকে ইলম অন্বেষণ করা যাবে না এবং তাদের নিকট (জ্ঞান) চাওয়াও যাবে না। অতঃপর আল্ললাহর শপথ! যেন জাহেল ব্যক্তির বুঝ, স্বভাব-মেজাজ এবং অন্তর (বিদআতীদের থেকে) নিরাপদ থাকে। এটা তার জন্য উত্তম। আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসারী (বিদ‘আতীদের) থেকে ইলম শিখবে তাহলে তার আক্বীদাহ ও মানহাজ নষ্ট হয়ে যাবে’।[7]

১০. জ্ঞান বৃদ্ধি ও জড়তার জন্য দো‘আ করা : জ্ঞান বা দ্বীনের বুঝ আল্ললাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নে‘মত। এই জ্ঞানার্জনকারী একজন জ্ঞানী কখনও পরিতৃপ্তি অনুভব করতে পরেন না। সারাজীবন জ্ঞানের সন্ধানে কাটিয়ে দেন। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْهُومَانِ لاَ يَشْبَعَانِ : مَنْهُومٌ فِى الْعِلْمِ لاَ يَشْبَعُ مِنْهُ ، وَمَنْهُومٌ فِى الدُّنْيَا لاَ يَشْبَعُ مِنْهَا ‘দু’জন লোভী ব্যক্তির পেট কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। একজন জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তি, যার পেট কখনও ইলম দ্বারা পরিপূর্ণ হয় না। অপরজন দুনিয়া পিপাসু ব্যক্তি, দুনিয়ার ব্যাপারে কখনও সে পরিতৃপ্ত হয় না’।[8]

এই জ্ঞানার্জন ও দৃঢ়ভাবে ধারণের জন্য আল্ললাহর কাছে দো‘আর মাধ্যমে সাহায্য চাইতে হয়। আল্ললাহ তা‘আলা বলেন, رَبِّ زِدْنِيْ عِلْمًا ‘হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও’ (ত্ব-হা ২০/১১৪)। অন্যত্র বলেন, رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ، وَيَسِّرْ لِيْ أَمْرِيْ، وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِىْ، يَفْقَهُوْا قَوْلِيْ ‘হে আমার প্রভু! আমার বক্ষ প্রসারিত করে দাও’ এবং আমার কর্ম সহজ করে দাও। ‘আর আমার জিহবার জড়তা দূর করে দাও। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ (ত্ব-হা ২০/২৫-২৮)

জ্ঞানীর পরিচয় :

তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বুদ নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/১৮)। তিনি আরো বলেন, وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘পক্ষান্তরে যারা জ্ঞান ও বিদ্যায় অভিজ্ঞ তারা বলে, আমরা উহার প্রতি ঈমান এনেছি, সবই আমাদের রবের তরফ থেকে এসেছে। সত্য কথা এই যে, কোন জিনিস হতে প্রকৃত শিক্ষা কেবল জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরাই গ্রহণ করে’ (আলে ইমরান ৩/৭)।

জ্ঞানী ব্যক্তির গুরুত্ব :

জ্ঞানী ব্যক্তি সর্বদা সম্মানিত। জ্ঞানীর মর্যাদা বা গুরুত্ব অপরিসীম। জ্ঞানীরা সমাজের প্রাণ। এদের মাধ্যমে প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হয় এবং কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা থাকে না। আল্ললাহ তা‘আলা জ্ঞানীর মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُو الْأَلْبَابِ ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? কেবলমাত্র জ্ঞানীরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (যুমার ৩৯/৯)। আর প্রকৃত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সর্বত্র সম্মানিত হবেন। আব্দুল্ললাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, لِيَلِنِي مِنْكُمْ أُولُو الْأَحْلَامِ وَالنُّهَى ‘তোমাদের মধ্যে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিগণই আমার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবেন’।[9]

জ্ঞানী ব্যক্তির মৃত্যুর মাধ্যমে ইলম তথা দ্বীনের সঠিক জ্ঞানের বিলুপ্তি ঘটবে এবং মূর্খতা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। আর এর জ্ঞানীরা না থাকলে দুনিয়ার শেষ ঘণ্টা বেজে যাবে এবং ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ، وَيَكْثُرَ الْجَهْلُ، ‘ক্বিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হ’ল ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে ও মূর্খতা বেড়ে যাবে’।[10] আল্লাহ মানুষের ক্বলব থেকে ইলম ছিনিয়ে নেবেন। জ্ঞানী ব্যক্তিকে উঠিয়ে নিবেন এবং মূর্খরা সমাজে নেতৃত্ব দিবে ও বিশৃংখলা ছড়াবে। আব্দুল্ললাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا. ‘নিশ্চয়ই আল্ললাহ বান্দাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম তুলে নিবেন না। বরং আলেমদেরকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নিবেন। অবশেষে যখন একজন আলেমকেও তিনি জীবিত রাখবেন না, তখন লোকেরা মূর্খ নেতাদের গ্রহণ করবে। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসিত হবে। তখন না জেনেই ফৎওয়া দিবে। এভাবে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[11]

সুতরাং সমাজে জ্ঞানী ব্যক্তিদের লালন ও দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া উচিৎ। জ্ঞানীরা নবী (ছাঃ)-এর ওয়ারিছ এবং সাধারণ মানুষের উপরে জ্ঞানীর মর্যাদা’।[12] প্রকৃত জ্ঞানীরা জ্ঞানের গগণে নক্ষত্রের মত চিরোজ্জবল। আবু মুসলিম আল-খাওলানি বলেন, ‘পৃথিবীর বুকে আলেমদের উদাহরণ হ’ল আকাশের তারাদের মতন, যতক্ষণ তাদের উপস্থিতি থাকে, মানুষ দিকনির্দেশনা পায়; কিন্তু যখন তারা অন্তরালে চলে যান, মানুষ দিশেহারা হয়ে যায় ও পথভ্রষ্ট হয়’।[13]

জ্ঞানী ও সাধারণ ব্যক্তির পার্থক্য :

ইলম আল্ললাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নে‘মত, যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। ইলম বা জ্ঞানকে আলোর সাথে তুলনা করা হয়েছে। অন্যদিকে অজ্ঞতাকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্ললাহ তা‘আলা বলেন, أَفَمَنْ يَعْلَمُ أَنَّمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَى إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ ‘যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে তা সত্য, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান যে অন্ধ? তারাই বোঝে যারা বোধশক্তিসম্পন্ন’ (রা‘দ ১৩/১৯) অন্যত্র বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيْرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّوْرُ. ‘বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান অথবা অন্ধকার ও আলো কি এক?’ (রা‘দ ১৩/১৬)। এ আয়াত থেকে বুঝা যায় অন্ধ ও চক্ষুষ্মান ব্যক্তির মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি জ্ঞানী ও জ্ঞানহীন ব্যক্তির মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক তফাৎ। একজন ইবাদতকারীর চেয়ে একজন জ্ঞানীর মর্যাদা অনেক উপরে। কারণ সাধারণ আবেদ ব্যক্তি দ্বীনের যথেষ্ট জ্ঞান রাখে না; কিন্তু আলেম দ্বীনের যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন এবং তা জীবনে প্রতিপালন করেন। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِىْ عَلَى أَدْنَى مِنْ أُمَّتِىْ ‘আবেদের উপরে আলেমের মর্যাদা হচ্ছে তোমাদের মধ্যে নিম্নতমের উপরে যেমন আমার মর্যাদা’।[14] কারণ আলেম সমাজ সবচেয়ে বেশী আল্ললাহকে ভয় করেন মর্মে আল্ললাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘নিশ্চয়ই আল্ললাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই তাঁকে বেশী ভয় করে’ (&ফাত্বির ৩৫/৮)।

একজন মূর্খ ব্যক্তি চিন্তাভাবনা ছাড়াই কথা বলে, পক্ষান্তরে একজন প্রকৃত জ্ঞানী চিন্তাভাবনা করে কথা বলে এবং জিহবাকে সংযত রাখে। প্রখ্যাত তাবিঈ ইমাম হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, ‘বুদ্ধিমান ব্যক্তির জিহবা তার হৃদয়ের পেছনে থাকে; সে যখন কথা বলতে চায়, প্রথমে সে চিন্তা করে। যদি শব্দগুলো তার জন্য কল্যাণকর হয় তাহ’লে সে তা বলে। আর যদি কথাগুলো তার জন্য অকল্যাণকর হয় তাহ’লে সে চুপ থাকে। কিন্তু একজন মূর্খ ব্যক্তির জিহবা তার হৃদয়ের সামনে থাকে; সে কথা বলার সময় খুব কমই চিন্তা করে এবং তার জন্য কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হোক যাচাই না করে সে বলে ফেলে’। অন্যত্র বলেন, ‘অজ্ঞ আমলকারী পথহারা পথিকের ন্যায়। সে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী করে। অতএব তুমি জ্ঞানার্জন কর এমনভাবে যাতে তা ইবাদতকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে, আবার ইবাদত কর এমনভাবে যেন তা জ্ঞানার্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। একদল লোক এমনভাবে ইবাদতে ডুবে থাকে যে তারা জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায় না, অথচ তারা উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর তরবারী চালিয়ে দেয়। যদি জ্ঞান থাকত তাহলে তারা এরূপ কর্মে লিপ্ত হতে পারত না’। শুধুমাত্র আমলকারীর চেয়ে জ্ঞানীর শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য চিরকাল।

জ্ঞানীদের করণীয় ও বর্জনীয় :

জ্ঞানী ব্যক্তি সর্বদা সর্বক্ষেত্রে দ্বীনের ওপর অবিচল থাকবেন অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক যা আদিষ্ট হয়েছে তা প্রতিপালন করবেন এবং যাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা থেকে বেঁচে থাকবেন। আর এজন্য দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা স্বরূপ।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ. ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার ও কাফেরের জন্য জান্নাত’।[15]

দুনিয়াতে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা দ্বীনের গন্ডির মধ্যে আবর্তিত হয়। কিন্তু আখিরাতে কল্পনাতীত জান্নাত অর্জন করে সেখানে রাজত্ব করবেন। আব্দুল্ললাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন,الدنيا سجن المؤمن، وأعظم أعماله في السجن الصبر وكظم الغيظ، وليس للمؤمن في الدنيا دولة، وإنما دولته في الآخرة، ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা স্বরূপ। আর এই জেলখানাতে তার সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে ধৈর্য ধারণ করা এবং ক্রোধ দমন করা। দুনিয়াতে মুমিনের কোন রাজত্ব নেই। প্রকৃতপক্ষে তার রাজত্ব কায়েম হবে আখেরাতে’।[16] এই জন্য দুনিয়াতে জ্ঞানীরা কুরআন সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী হবেন এবং যাবতীয় বর্জনীয় বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে চলবেন।

ক. জ্ঞানী ব্যক্তির যা করণীয় :

১. দ্বীনের সঠিক জ্ঞানার্জন করা :

যে প্রকৃত জ্ঞানী হতে আকাংখিত সে যেন সর্বপ্রথম দ্বীনের সঠিক জ্ঞান তথা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা উচিৎ। ইমাম বুখারী (রহঃ) ছহীহ বুখারীতে ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন করা’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন।[17] জ্ঞানী হতে গেলে অবশ্যই দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়। আবু দারদা (রাঃ) বলেন, ‘কোন মানুষ জ্ঞানী হয়ে জন্ম নেয় না। তাকে জ্ঞান অর্জন করতে হয়’।[18]

আমাদের রাসূল (ছাঃ) অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। আল্ললাহ তা‘আলা জিব্রীল (আঃ)-কে পাঠিয়ে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা হ’ল ‘পড়’। আল্ললাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ. ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। পড় এবং তোমার প্রতিপালক মহা সম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)।

দুনিয়ার জীবনে অহীর জ্ঞানার্জন করা ফরয। আর আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর দ্বীনী ইলম (অহীর জ্ঞান) শিক্ষা করা ফরয’।[19]

সঠিক জ্ঞান ব্যতীত মানুষ গোমরাহীতে নিপতিত হবে। সঠিক জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করায় এবং হক্ব বলতে ও মানতে সাহায্য করে। দ্বীন প্রতিপালনের পূর্বে জেনে বুঝে জ্ঞানার্জন করতে হবে। আল্ললাহ তা‘আলা বলেন,فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘সুতরাং জেনে রাখো, আল্ললাহ ছাড়া (সত্য) কোন ইলাহ নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। ‘জেনে রাখো’ বাক্য দ্বারা আল্ললাহ তা‘আলা ‘ইলম শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের’ কথা বলেছেন।

বিশুদ্ধ ইলম অর্জনের নির্দেশনা স্বরূপ আল্ললাহ সুবহানা ওয়া তা‘আলা জ্ঞানীদের নিকটে অজানা বিষয় জেনে নিতে বলেছেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো যদি তোমরা না জান’ (আন-নাহল ১৬/৪৩)।

মানুষের দেহের রোগের চেয়ে আত্মার ব্যাধি অতীব মারাত্মক হয়। আর এর চিকিৎসা প্রকৃত জ্ঞানীদের নিকটে মিলে, যখন তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِىِّ السُّؤَالُ ‘নিশ্চয়ই অজ্ঞতার চিকিৎসা হ’ল জিজ্ঞাসা’।[20] এই জন্য জেনে বুঝে সঠিকটা গ্রহণ করতে হয়, যাতে আত্মা প্রশান্তি অনুভব করে। হযরত আবি ছা‘আলাবা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন,

الْبِرُّ مَا سَكَنَتْ إِلَيْهِ النَّفْسُ وَاطْمَأَنَّ إِلَيْهِ الْقَلْبُ وَالإِثْمُ مَا لَمْ تَسْكُنْ إِلَيْهِ النَّفْسُ وَلَمْ يَطْمَئِنَّ إِلَيْهِ الْقَلْبُ وَإِنْ أَفْتَاكَ الْمُفْتُونَ

‘সৎ কর্মে আত্মা প্রশান্ত থাকে এবং অন্তর থাকে ধীরস্থির। আর গুণাহের কাজে আত্মা প্রশান্ত থাকে না এবং অন্তরও ধীরস্থির থাকে না। যদিও মুফতিগণ সে বিষয়ে তোমাকে ফতওয়া প্রদান করেন’।[21]

আর বিশুদ্ধ ইলম অর্জনে কোন বয়সসীমা নেই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করতে হবে। হাসান বিন মানছূর আল-জাচ্ছাছ বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কত বছর পর্যন্ত একজন মানুষ লেখাপড়া শিখবে? তিনি বললেন, মৃত্যু পর্যন্ত।[22]

আর এরাই উত্তম ব্যক্তি যারা দ্বীন শিখে, পালন করে এবং অপরের নিকটে পৌঁছে দেয় বা অন্যকে শিক্ষা দেয়। ওছমান (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়’।[23]

একজন ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সহনশীলতার ক্ষমতা ও কল্যাণ লাভ করে থাকে। আবু দারদা (রাঃ) বলেন, ‘জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে উপার্জিত হয় ধৈর্যধারণের ক্ষমতা। যে ব্যক্তি কল্যাণের খোঁজে ব্যস্ত হয়, সে কল্যাণই অর্জন করে। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে, সে অকল্যাণ থেকে রক্ষা পায়’।[24] অন্যত্র মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা জ্ঞানার্জন কর। কেননা আল্ললাহর উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জনের অর্থ তাঁকে ভয় করা। জ্ঞানের আকাংখা করা ইবাদত। জ্ঞান চর্চা করা হ’ল তাসবীহ। জ্ঞানের অনুসন্ধানও জিহাদ করা। অজ্ঞ ব্যক্তিকে জ্ঞান দেওয়া ছাদাকাহ। উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা ব্যয় করা আল্ললাহর নৈকট্য অর্জনের যথার্থ মাধ্যম। আর তা হালাল-হারাম জানার মানদন্ড, একাকিত্বের বন্ধু, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, সুখ-দুঃখের ধ্রুবক, চরিত্রের সৌন্দর্য, অপরিচিতের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যম। আল্ললাহ জ্ঞানের দ্বারা মানুষকে এমন মর্যাদাবান করেন, যা স্থায়ীভাবে তাকে অনুসরণীয় করে রাখে’।[25]

সম্পদশালী হওয়ার চেয়েও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে পান্ডিত্য অর্জন করা উত্তম। জ্ঞান ও অর্থ-সম্পদের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আলী (রাঃ) বলেন, ‘জ্ঞান অর্থ-সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা জ্ঞান তোমাকেই পাহারা দেয় কিন্তু অর্থকে পাহারা দিতে হয়। অথচ জ্ঞান হ’ল শাসক, আর অর্থ হ’ল শাসিত। অর্থ ব্যয় করলে নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে আরও বৃদ্ধি পায়’।[26]

২.তাক্বওয়াশীল হওয়া :

তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি জ্ঞানীদের মধ্যে শামিল হ’লে তাঁর কথা ও কাজে আল্ললাহ বারাকাহ দান করেন। দ্বীনের দাওয়াত প্রসারে অতিব দ্রুত ফলপ্রসূ হয়। তাক্বওয়াই হ’ল প্রকৃত ইলম। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, .وَمِلَاكُ الدِّينِ الْوَرَعُ ‘দ্বীনের মূল হ’ল তাক্বওয়া’।[27] ইবনু কাছীর বলেন, তাক্বওয়ার মূল অর্থ হ’ল التوقي ما يكره ‘অপসন্দনীয় বিষয় থেকে বেঁচে থাকা’। অর্থাৎ দ্বীন পালনের ব্যাপারে তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদ‘আত, হালাল-হারাম, সত্য-মিথ্যা প্রভৃতি বিষয়ে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা।

একজন জ্ঞানীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হ’ল তিনি আল্ললাহভীরু হবেন। আল্ললাহভীতি ছাড়া পাহাড় পরিমাণ জ্ঞান কোনই কাজে আসবে না। আল্ললাহ বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্ললাহর বান্দাদের মধ্যে মূলতঃ জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। বেশী বেশী হাদীছ জানা ও তা মানা একজন জ্ঞানীর তাক্বওয়ার মানদন্ড। আব্দুল্ললাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ জানাই প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং প্রকৃত জ্ঞানার্জন হ’ল আল্ললাহভীতি অর্জন করা’।[28] আমলহীন ইলম কোন কাজে আসে না, যদিও সে পর্বতের মত জ্ঞানী হয়। জনৈক আরবী কবি বলেন,لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس ‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলীস আল্ললাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত।[29] আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) তাঁকে বলেছেন, إِنَّكَ لَسْتَ بِخَيْرٍ مِنْ أَحْمَرَ وَلَا أَسْوَدَ إِلَّا أَنْ تَفْضُلَهُ بِتَقْوَى ‘তুমি লাল বর্ণ বা কালো বর্ণ বিশিষ্ট হলেই উত্তম হবে না; বরং আল্ললাহভীতি দ্বারাই তুমি শ্রেষ্ঠ হবে’।[30]

সাহল ইবনু আব্দুল্ললাহ বলেন, ‘যখন কোন মুমিন...তাক্বওয়া অবলম্বন করবে, তখন তার অন্তর আল্ললাহ রাববুুল আলামীনের সাথে যুক্ত হবে’।[31]

৩. বিশুদ্ধ ইলম অনুযায়ী আমল করা :

দুুনিয়াবী জীবনে দ্বীন পালনের ব্যাপারে তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদ‘আত, হালাল-হারাম, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দ প্রভৃতি বিষয়ে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে সঠিক গ্রহণ এবং যা বাতিল তা বর্জন করা। অহীর জ্ঞানার্জন ও বিশুদ্ধ আমলের মাধ্যমে একজন মানুষ সুশিক্ষিত হিসাবে গড়ে উঠে। আর সুশিক্ষা মানুষকে বিবেকবান ও অধিক তাক্বওয়াশীল করে।

ইলমের অপর নাম তাক্বওয়া। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, -وَمِلَاكُ الدِّينِ الْوَرَعُ ‘দ্বীনের মূল হ’ল তাক্বওয়া’।[32] আবার তাক্বওয়ার সাথে সম্পূরক হ’ল ইবাদত। ইলম অর্জন যেমন ফরয তেমনি তদানুসারে আমল করা ওয়াজিব। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, وما العلم إلا العمل به والعمل به ترك العاجل للآجل ‘ইলম হচ্ছে আমলের নাম। আর আমল হ’ল স্থায়ী জগতের স্বার্থে ক্ষণস্থায়ী জগত পরিহার করা’।[33] অন্যত্র সাহল ইবনু আব্দুল্ললাহ বলেন, ‘যখন কোন মুমিন তার ইলম অনুযায়ী আমল করবে, তখন তার ইলম তাকে তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতার দিকে পথ প্রদর্শন করবে’।[34]

রাসূল (ছাঃ) যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তা যথাসাধ্য রপ্ত করা ও জীবনে প্রতিপালন করা। অর্থাৎ- আল্ললাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যে সকল বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করেছেন, সেসব বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানর্জন করা। আল্ললাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)।

ইলম অর্জনের যে চারটি ধাপ রয়েছে তন্মধ্যে তৃতীয় ধাপ হ’ল ইলম অনুসারে আমল করে তা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ইলম অর্জনের পরে ইলম অনুযায়ী আমল করা’।[35]

ইলম অর্জন করা যত কঠিন তদানুযায়ী আমল করা তার চেয়ে অধিক কঠিন। হিলাল ইবনুল আ‘লা (রহঃ) বলেন, ‘ইলম অর্জন করা কঠিন কাজ। এর চেয়ে কঠিন কাজ ইলম সংরক্ষণ করা। আর তার চেয়েও অনেক কঠিন কাজ ইলম অনুযায়ী আমল করা’।[36]

ইলম অনুযায়ী আমল না করলে ক্বিয়ামতের মাঠে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। উসামা ইবনু যায়দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন জনৈক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আগুনে তার নাড়ী-ভূড়ি বেরিয়ে যাবে। তখন সে ঐ নাড়ী-ভূড়ির চতুর্দিকে ঘুরতে থাকবে। যেমনভাবে গাধা ঘানির চারদিকে ঘুরে থাকে। এ অবস্থা দেখে জাহান্নামবাসীরা তার চারপাশে জড়ো হবে ও তাকে লক্ষ্য করে বলবে, أَيْ فُلَانُ مَا شَأْنُكَ؟ أَلَيْسَ كُنْتَ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَانَا عَنِ الْمُنْكَرِ؟ ‘হে অমুক! তোমার এ কি অবস্থা? তুমি না সর্বদা আমাদেরকে ভাল কাজের উপদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে? তখন লোকটি জবাবে বলবে,كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَلَا آتِيهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ ‘আমি তোমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু নিজে তা করতাম না। আমি তোমাদেরকে মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতাম; কিন্তু আমি নিজেই সে কাজ করতাম’।[37]

প্রত্যেকের উচিৎ সাধ্যমত জ্ঞানার্জন করে তদানুযায় আমল করা। আর তা না করলে ক্বিয়ামতের মাঠে নিঃস্ব ও আমানতের খেয়ানতকারী হিসেবে উঠবে। ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি.) বলেন,المِسْكِينُ كُلُّ المِسْكِيْنِ مَنْ ضَاعَ عُمْرَهُ فِي عِلْمٍ لَمْ يَعْمَلْ بِهِ، فَفَاتَتْهُ لَذَّاتُ الدُّنْياَ وَخَيْرَاتُ الآخِرَةِ، فَقَدِمَ مُفْلِسًا عَلىَ قُوَّةِ الحُجَّةِ عَلَيْهِ ‘সব মিসকীনের বড় মিসকীন সেই, যে তার সারাটা জীবন ব্যয় করল জ্ঞানের অন্বেষণে। অথচ সে অনুযায়ী আমল করল না। ফলে সে দুনিয়াবী সুখ থেকে বঞ্চিত হ’ল এবং আখেরাতের কল্যাণ সমূহ থেকেও বঞ্চিত হ’ল। অতঃপর নিজের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সাক্ষ্যের বোঝা নিয়ে সে নিঃস্ব অবস্থায় হাশরের ময়দানে উপস্থিত হ’ল’।[38] (ক্রমশঃ)

 [ লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী ]


[1]. মুসলিম হা/১৪; মিশকাত হা/২৭৩; দারেমী হা/৪২৪; ছহীহ হাদীছ।

[2]. মাওসূ‘আ আলবানী ফিল আক্বীদাহ ৮/১১০।

[3]. আয-যুহদ লি ইবনিল মুবারাক, হা/৮১৫; মুছান্নাফে ‘আব্দুর রাযযাক, হা/২০৪৪৬; মু‘জামুল কাবীর হা/৮৫৮৯।

[4]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, ৫/১১৮-১১৯।

[5]. বুখারী হা/৭৭।

[6]. ত্বরীকুল হিজরাতাইন, পৃঃ ৩৮৬-৮৭।

[7]. আল ফাতওয়া ১/৩০১।

[8]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, দারেমী হা/৩৩১; হাসান, মিশকাত হা/২৬০ সদন ছহীহ।

[9]. মুসলিম হা/৪৩২; মিশকাত হা/১০৮৯।

[10]. বুখারী হা/৮০; মুসলিম হা/২৬৭১; মিশকাত হা/৫৪৩৭।

[11]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।

[12]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, ২১৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৪২১৩।

[13]. আল-বায়হাকী, আল-মাদখাল ইলা আল-সুনান আল-কুবরা, ২৮৭।

[14]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, ২১৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৪২১৩।

[15]. মুসলিম হা/২৯৫৬; মিশকাত হা/৫১৫৮।

[16]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, তাম্বীহুল মুগতাররীন, পৃ. ১০৯।

[17]. বুখারী পৃঃ ১৬।

[18]. কিতাবুল ইলম, ইবনে খায়ছামাহ, পৃঃ ২৮।

[19]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮; ছহীহুল জামি‘ হা/৩৯১৩; ছহীহ হাদীছ।

[20]. আবূ দাঊদ হা/৩৩৬; মিশকাত হা/৫৩১; দারাকুৎনী হা/৭৪৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৪৩৬২; হাসান ছহীহ।

[21]. ছহীহুল জামি‘ হা/২৮৮১

[22]. ত্বাবাকাতুল হানাবিলাহ ১/১৪০।

[23]. মিশকাত হা/২১০৯

[24]. কিতাবুল ইলম, ইবনে খায়ছামাহ, পৃঃ ২৮।

[25]. আল-আজুরী, আখলাকুল ওলামা, পৃঃ ৩৪-৩৫।

[26]. ইমাম গায্যালী, ইহয়াউল উলূম, ১/১৭-১৮।

[27]. মিশকাত হা/২৫৫; ছহীহুল জামি‘ হা/১৭২৭; সনদ ছহীহ।

[28]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, ১৪৭ পৃঃ।

[29]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী, ১/১৩।

[30]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫১৯৮।

[31]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫।

[32]. মিশকাত হা/২৫৫; ছহীহুল জামি‘ হা/১৭২৭; সনদ ছহীহ।

[33]. আল মাদখাল লিল বায়হাক্বী, হা/৪৭৫।

[34]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫।

[35]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৬২।

[36]. ইমাম যাহাবী, আল কাবাইর, পৃষ্ঠা-৭৬।

[37]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫১৩৯, ‘সৎ কাজের নির্দেশ’ অনুচ্ছেদ।

[38]. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বের ১৫৯ পৃ.।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও