Thirty first Night (থার্টি ফাস্ট নাইট)
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
শ্রদ্ধেয়
অধ্যাপক আমীনুল ইসলাম ভাইয়ের কথা কোনটা লিখব আর কোনটা ছাড়ব সেটা ভেবেই কুল
পাচ্ছি না। কেননা দীর্ঘদিন থেকে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখা। ১৯৯৬ সালে আমি
যখন ক্লাস ফোরের ছাত্র, তখন অধ্যাপক আমীনুল ইসলাম ভাই ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ
যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল। তিনি একাধারে তিন সেশনের সভাপতি ছিলেন।
সংগঠনের বিপদসংকুল দিনগুলিতে তিনি বুক পেতে আগলিয়েছেন সবকিছুকে। সংগঠনের
সার্বিক দেখভাল করেছেন। মারকাযের ছাত্র হিসাবে ‘যুবসংঘ’ অফিসে আমাদের
ঘোরাঘুরি ছিল ছোট কাল থেকেই। প্রত্যেক দায়িত্বশীল বড় ভাইকেই আমরা
শিক্ষাগুরুই মনে করতাম। এরপরও আমাদের কাছে তাঁর একটা বিশেষ শান ও মান ছিল
সবসময়।
২০১৪ সালে হঠাৎ তাঁর ফোন পেলাম। তখন আমি গোদাগাড়ীতে কর্মরত ছিলাম। কেমন আছ? আমরা তোমাকে ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখতে চাচ্ছি, তুমি তোমার মতামত দাও। আমি হতচকিত অবস্থায় পড়ে গেলাম। এতবড় একজন মানুষ আমার মত ছোট মানুষকে ফোন দিয়েছেন। আমি বললাম, দেখেন ভাই, আপনি আমাদের উস্তাদের মত, যেটি ভাল মনে করেন, করুন। তারপর আমি তাঁর প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, তথ্য ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং বর্তমানে সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি।
তিনি তাওহীদের ডাক পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন শুরু থেকেই। আমি কেন্দ্রে আসার পর পরই ‘যুবসংঘে’র মুখপত্র দ্বি-মাসিক ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার দায়িত্ব দিয়ে চরম কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। অনেক শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। পরবর্তীতে মারকাযের শিক্ষক হিসাবে যখন আমার নিয়োগ হল। তখন তাঁর কাজের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করার অসাধারণ যোগ্যতা দেখেছি। তিনি খুবই শান্তশিষ্ট, নম্র-ভদ্র ও ক্ষমাশীল মানুষ ছিলেন। তিনি মারকাযের সেক্রেটারীর কঠিন দায়িত্ব বেশ দাপট ও সুনামের সাথে পরিচালনা করতেন। কারো কোন ভুল হলে বোকা দিতেন। আবার পরক্ষণেই স্নেহভরে আদর করে ভুলগুলি শুধরিয়ে দিতেন। বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবলে যখন পুরো বিশ্ব ছিন্নভিন্ন, তখন শিক্ষকদের জন্য তিনি যে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা ভাষায় বলার মত না। সবাই ঘরে বন্দী, মানবতার মৌলিক অধিকারসমূহ বিশেষকরে খাদ্য সংকটের চরম মুহূর্তে যেভাবে তিনি শিক্ষকদের অভয় দিয়েছেন, খোঁজ-খবর নিয়েছেন তা সত্যিই মানবিক একজন দায়িত্বশীলের চরম ত্যাগের পরকাষ্ঠারই জানান দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানকে অগ্রগতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করানোর জন্য তাঁর নিরলস অবৈতনিক নিখাদ প্রচেষ্টা ও ত্যাগ-তিতীক্ষা সত্যিই প্রবাদতুল্য।
তিনি যখন স্বাভাবিক অসুস্থতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন, বাড়ি থেকে মাদরাসা, আবার মাদরাসা থেকে বাড়ি, এই ডাক্তার থেকে সেই ডাক্তার, ঠিক তখুনি ‘যুবসংঘে’র মাননীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ভাই আমাকে তাঁর সাক্ষাৎকার পত্রিকায় দেওয়ার জন্য তাগাদা দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে সাক্ষাৎকারটি আদায় করে নেওয়ার জন্য গল্পচ্ছলে মাদরাসা, সংগঠন, বাড়ি, কলেজ বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলাম, চেষ্টার ক্রুটি করিনি বলে আমার কাছে মনে হয়, সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, কাল সকালে আস অথবা কাল বিকেলে আস। যাও, আমি ফ্রি হলে তোমাকে কল দিয়ে ডেকে নিব ইত্যাদি।
হঠাৎ ভাইয়ের অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা যেতে হল। ঢাকা যাওয়াই তাঁর জীবনের শেষ যাওয়া হবে তা কে জানত? তিনি ঢাকা থেকে ফিরেও আসলেন। তাঁকে দেখতে গেলাম। তিনি মারকাযের মেহমানখানায় শুয়ে আছেন নিথর, নিস্তব্ধ অবস্থায়। অথচ তিনি সুস্থাবস্থায় যখন মাদরাসায় আসতেন, তখন শিক্ষক, কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে মৃদু কম্পন বয়ে যেত। যেতেই হাতটা দেখি লেপের মধ্যে থেকে বের করার চেষ্টা করছেন, হাতটা বের করলেন আমার সাথে মুছাফাহা করলেন। কে জানে এটাই আমার সাথে দুনিয়া জীবনের শেষ বিদায়। বুকফাঁটা কান্না এসে গেল আমার। কেননা একদিন মারকাযের পূর্ব পার্শবস্থ বিল্ডিং-এর দ্বিতীয় তলায় সাক্ষাৎকার সুলভ মারকাযের ইতিহাস বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমীরে জামা‘আত যখন হড়গ্রাম ভাড়া বাসায় থাকতেন, একদিন তিনি আমাকে একটি যরূরী চিঠি দিয়ে নওদাপাড়ায় পাঠিয়েছিলেন। সাইকেলে চড়ে এখানে আসলাম। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁর বাসায় যেতাম, স্যার আদেশ করতেন, জীবনে কত কষ্ট করেছি, মারকায তৈরীর এসব পেছনের ইতিহাস কেউ জানে না... তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। মারকাযের দোতলার ফ্লোরে কয়েক চক্কর দিলেন, ছোট মানুষের মত কাঁদতেই থাকলেন। আমি হতবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাকে থামানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু না, থামলেন না। যাও, পরে এস- বলে বিদায় দিলেন।
মারকাযের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মাওলানা ফযলুল করীম উস্তাদজী হঠাৎ করে ভীষণ সংকটময় অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন। অসুস্থতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। মাদরাসার একজন যোগ্য সেক্রেটারী হিসাবে তিনি যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা আমাদের সকলেরই জানা। যেখানে উস্তাদজীকে আমরা হারাতে বসেছিলাম, সেখানে এইভাবে তাঁকেই আমরা হারিয়ে ফেললাম। তাঁর সাক্ষাৎকারটা আমাদের নছীবে জুটলো না। তিনি মাদরাসা ও সংগঠনের জন্য যে সাহসী ভূমিকা রাখতেন, মেহনত করতেন, তা কোনদিনই ভোলার নয়। শেষ সাক্ষাতে গিয়ে শুনলাম, তিনি নাকি সুস্থ হয়ে উঠলে আরো জোরেশোরে দ্বীনের পথে সময় দিবেন এবং সংগঠনের কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। এমন একজন মানুষ চলে যেতে পারে, ভাবতেই কষ্ট লাগে। তিনি আমাদের চির ঋণী করে চলে গেলেন। মহান আল্লাহ সবকিছুর বিনিময়ে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নছীব করুন-আমীন!