মাহে রামাযান : মুছে যাক যাবতীয় গ্লানি
মুযাফফর বিন মুহসিন
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1210 বার পঠিত
দুনিয়াবী
জীবনের রূঢ় বাস্তবতা, দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার অবিশ্রান্ত মহড়া আমাদের এতটাই
আত্মভোলা করে রাখে যে, প্রায়শঃই আমরা বিস্মৃত হই যে, দুনিয়াবী জীবন আমাদের
জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। আমাদের প্রাত্যহিক যাপিত জীবন, আমাদের উপর আপতিত
বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, সুখ-আনন্দ সবকিছুই এই পরীক্ষার নিত্য অনুষঙ্গ। আমাদের
প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি আচরণের অন্তরালে চলে চুলচেরা হিসাব-নিকাশ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)।
সবকিছুর মধ্যেই নিহিত মহান স্রষ্টার এক নিখুঁত কর্মকৌশল, যার পশ্চাতে
লুকিয়ে থাকে বইয়ের পৃষ্ঠার মত ধারাবাহিক একের পর এক এলাহী নিদর্শন আর
কার্যকারণ। কখনও এই পরীক্ষা এতই সূক্ষ্ম যে, তার বাস্তবতা অনুভব করতে
আমাদের সীমিত জ্ঞান ও বিবেক অক্ষম। কখনও পরীক্ষার ধরনগুলোও এমন বিস্তৃত
শাখা-প্রশাখাময় যে, বাস্তবিকপক্ষে তা যে কোন পরীক্ষার অংশ, তা আমাদের
ধারণারও অতীত হয়।
কখনও মহান রব সুনিশ্চিত বিপদ কিংবা মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে পরীক্ষা নেন- আমরা কতটুকু রবের প্রতি শোকরগুযার; আবার কখনও কঠিন বিপদ চাপিয়ে পরীক্ষা নেন- কতটুকু আমরা রবের সিদ্ধান্তে সন্তোষভাজন। কখনও আমাদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে দিয়ে পরীক্ষা নেন- কে আমাদের মধ্যে রবের বিধানের প্রতি আনুগত্যশীল আর কে সীমালংঘনকারী। কখনও মানুষকে দলে দলে বিভক্ত করে পরীক্ষা নেন- কে সঠিক পথের উপর অবিচল থাকতে চায় আর কে পথভ্রষ্ট। কখনও দুনিয়াবী প্রলোভনের বস্ত্তগুলো সামনে হাযির করে পরীক্ষা নেন- কে রবকে বেশী অগ্রাধিকার দেয় আর কে নিজের নফসকে। কার নিয়ত শুদ্ধ আর কার নিয়ত অশুদ্ধ। কখনও পারস্পরিক দুনিয়াবী স্বার্থ সামনে এনে পরীক্ষা নেন- দুনিয়ার মোহ আমাদের কাছে বড়, নাকি পরকালীন মুক্তি। অন্যের হক রক্ষা করা যরূরী, নাকি নিজের অন্যায় স্বার্থসিদ্ধি।
কখনও সফলতা দিয়ে পরীক্ষা নেন-আমরা অহংকারী, নাকি রবের রহমতের ভিখারী। কখনও বিফলতা দিয়ে পরীক্ষা নেন- আমরা অনুযোগকারী, নাকি কল্যাণের প্রত্যাশায় ধৈর্যধারণকারী। কখনও দারিদ্র্য চাপিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেন- আমরা হালাল উপার্জন প্রত্যাশী, না হারাম উপার্জন। কখনও ধনাঢ্য করে পরীক্ষা নেন- আমরা হালাল পথে ও নেকীর কাজে ব্যয়ের অভিলাষী, নাকি হারাম বিলাস-ব্যাসনে সম্পদ অপচয়কারী। কখনও পাপের কাজের সম্মুখীন করে পরীক্ষা নেন- কতটা আমরা রবের প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল ও তওবাকারী আর কতটা অবাধ্য ও স্বেচ্ছাচারী। কখনও নেকীর কাজ করিয়ে পরীক্ষা নেন- কতটা তা আল্লাহর জন্য ইখলাছপূর্ণ আর কতটা ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা দুনিয়াবী প্রাপ্তির জন্য। কখনও দ্বীনদারীর পরীক্ষা নেন- কতটা আমরা আল্লাহর ভয়ে দ্বীন পালন করি, আর কতটা অন্ধ ভালবাসা, অধিকাংশের ভয় কিংবা ব্যক্তিগত গোঁড়ামী থেকে পালন করি। এরূপ হাযারো মাধ্যমে, হাযারো পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেন এবং নিচ্ছেন, সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব রাখছেন- আমাদের অগোচরে।
বর্তমান যুগে আমাদের আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয়বস্ত্ত দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সম্পদহানি। অথচ এসব বিষয় মানবজীবনের একান্ত অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যা থেকে চাইলেই বের হওয়া সম্ভব নয়। বরং কারা আল্লাহর উপর প্রকৃত ভরসাকারী, কারা উত্তম ধৈর্যশীলতা অবলম্বনকারী, তা বাছাই করে নিতে আল্লাহ এটা আমাদের জন্য অবধারিত করে রেখেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। (এমতাবস্থায়) আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)। কখনও আল্লাহ উপদেশ গ্রহণ করার জন্য বান্দার পরীক্ষা নেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা কি লক্ষ্য করে না যে, তারা প্রতি বছর একবার বা দু’বার কোন না কোন বিপদে পতিত হয়ে থাকে? তবুও তারা তওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণও করে না’ (তওবা ৯/১২৬)।
কখনও ঈমানদারদের দল-উপদলে বিভক্ত হতে দেখে আমরা হতাশা বোধ করি আবার কেউ নিজেকে দায়মুক্ত ভেবে সঙ্গোপনে এক প্রকার আত্মতুষ্টিও লালন করি। অথচ এই দলবিভক্তি যে আল্লাহর পরীক্ষারই অংশ এবং এর মাধ্যমে যে তিনি অধিকতর ভাল মানুষ বাছাই করে নেন, তা আমরা কয়জনই বা অবগত? আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে তিনি তোমাদের (ঐক্যবদ্ধ) এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। তবে তিনি চান তোমাদেরকে যা কিছু প্রদান করেছেন, তা দিয়ে পরীক্ষা করতে। অতএব তোমরা কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা কর’ (মায়েদাহ ৫/৪৮)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে তোমাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। আর তোমরা যা করছ, সে বিষয়ে তোমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে (নাহল ১৬/৯৩)। সুতরাং মুসলিমদের মধ্যে একতা কাম্য হলেও তা হবার নয়। কেননা এই বিভক্তির মধ্য দিয়েই আল্লাহ সত্যিকারের মুমিন কারা তাদেরকে বাছাই করে নেন।
আবার ঈমানদার ও দ্বীনদার হলেই যে আমরা আল্লাহর পরীক্ষা থেকে বেঁচে যাব, এমনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। বরং তাদের জন্য পরীক্ষাটা আরো বড়। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি-এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়া হবে’? (আনকাবূত ২৯/২)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা নেয়া হয় নবীদের। তারপর বান্দার দ্বীনদারীর মাত্রার উপর পরীক্ষা করা হয়। যে যত দ্বীনদারীতে অবিচল, সে তত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়’ (তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩)। কেন আল্লাহ ঈমানদারদের পরীক্ষা নেন?
ক.
ঈমানের দাবীর সত্যতা ও নিয়তের ভালো-মন্দ যাচাই করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি
অবশ্যই তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম। সুতরাং আল্লাহ অবশ্যই
জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/৩)।
খ. ইখলাছ ও তাক্বওয়াশীলতা যাচাই করা। কারা আল্লাহর প্রকৃত মুখলিছ বান্দা আর কারা প্রকৃত আল্লাহভীরু, তার পরীক্ষা আল্লাহ নিয়ে থাকেন নানা রূপে। আমলের পরীক্ষায় অনেকে বিপুল সমৃদ্ধ হলেও ইখলাছ ও তাক্বওয়ার ঘাটতিতে হারিয়ে যায় আমলের সুফল (মায়েদাহ ৫/২৭; কাহাফ ১৮/১০৩; মুসলিম হা/২৫৮১)।
গ. দ্বীনের ব্যাপারে অধিক অগ্রগামিতা যাচাই : দ্বীন পালনে সবাই সমান নয়। সবাই একই মর্যাদার অধিকারীও নয়। দ্বীনের প্রতি অগ্রগামিতার প্রতিযোগিতায় অগ্রসরদের নির্বাচন করা এই পরীক্ষার অংশ (নিসা ৪/৯৫; ফাত্বির ৩২)।
ঘ. হককে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী নির্বাচন করা : ঈমানদারীর দাবী সত্ত্বেও বান্দা সত্যিই হকের অনুসরণকারী কি-না কিংবা কতটুকু অনুসন্ধানী তা যাচাই করা এই পরীক্ষার অংশ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
ঙ. জান্নাতে উচ্চতর স্থান নির্ধারণ : জান্নাতীরা সবাই সমান স্তরের হবে না। তাদের আমলের শুদ্ধতা ও পরীক্ষায় সফল হওয়ার মাপকাঠিতে আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাতের বিভিন্ন স্তর নির্ধারণ করে রাখবেন (আন‘আম ৬/১৩২)।
চ. পরিশুদ্ধ করা : আল্লাহ যাদের কল্যাণ চান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্যও তাদেরকে বিপদগ্রস্থ রেখে পরীক্ষা নেন, যাতে একসময় সে গুনাহমুক্ত হয়ে যায় (তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩)।
সুতরাং দুনিয়ায় আমাদের যাপিত জীবনের সবটুকু অংশই যে এক মহা পরীক্ষার অংশ এবং এতে সফল হওয়াই আমাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তা যতই আমরা অনুধাবন করব এবং তার প্রভাব যত বেশী আমাদের জীবনাচরণে পরিলক্ষিত হবে, ততই আমরা সফলতার উচ্চ সোপানে আরোহণ করতে পারব। আল্লাহ রববুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন।- আমীন!