জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনের সুফল
লিলবর আল-বারাদী
ভূমিকা : আখেরাতে মুক্তির লক্ষ্যে প্রত্যেক মুমিনকে সর্বদা নেক আমল করতে হবে। যা তাকে সৌভাগ্যবান করবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ধন্য করবে। তাকে ফরয ও ওয়াজিব আমলগুলোর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রত্যেক দিন শেষে একটি সময় বের করে নিরিবিলি পরিবেশে তার সেদিনের কর্মকান্ডের ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করতে হবে। সে যদি ফরয সমূহ পালনে কোন ত্রুটি হয়েছে বলে মনে করে, তবে স্বীয় নাফসকে সে ধিক্কার ও তিরস্কার করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা পরিশুদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর এটাই হ’ল ‘ইহতিসাব’ বা আত্মসমালোচনা।
‘ইহতিসাব’ হ’ল নফসকে পরিশুদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম। আখেরাতে মুক্তির লক্ষ্যে দুনিয়ায় পাথেয় সঞ্চয় করার তাকীদ দিয়ে আল্লাহ বলেন,يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ، وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌم بِمَا تَعْمَلُوْنَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেকে ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কি অগ্রিম পাঠিয়েছে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমাদের কৃতকর্ম বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত’ (হাশর ৫৯/১৮)। সুতরাং এর মধ্যে ব্যক্তিকে প্রতিক্ষিত আগামী দিন তথা পরকালের জন্য কী আমল করা হয়েছে, সে বিষয়ে আত্মসমালোচনা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
ইহতিসাব : এটিকে আরবীতে اَلْإِحْتِسَابُ বা اَلْمُحَاسَبَةُ বলা হয়। ইংরেজীতে self-criticism বা Self-review অথবা self-accountability অর্থাৎ আত্মসমালোচনা বা ব্যক্তিগত পর্যালোচনা বলা হয়। আর মুমিনগণ তাদের যাবতীয় সৎকর্মে স্রেফ আল্লাহর নিকটে ছওয়াব কামনা করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ- ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ছিয়াম রাখে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[1]
আল্লাহ বলেন,فَأَمَّا مَنْ طَغَى- وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى- وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى- فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘যে সীমালংঘন করবে এবং দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিবে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর যে তার প্রভুর সামনে দাঁড়ানোর ভয় করবে এবং আত্মাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত রাখবে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত’ (নাযি‘আত ৭৯/৩৭-৪১)।
ইহতিসাবের গুরুত্ব
এ বিষয়ে হযরত ওমর (রাঃ) বলেন,حَاسِبُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوْا، وَزِنُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُوْزِنُوْا، فَإِنَّّهُ أَهْوَنُ عَلَيْكُمْ فِيْ الْحِسَابِ غَدًا، أَنْ تُحَاسَبُوْا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ، وَتَزَيَّنُوْا لِلْعَرْضِ الأَكْبَرِ يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُوْنَ لاَ تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ- ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না’।[2]
কারো উচিৎ নয় নিজেকে দোষমুক্ত মনে করা। কুরআনে ইউসুফ (আঃ)-এর যবানীতে এসেছে- وَمَآ أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌم بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّي إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ- ‘আর আমি নিজেকে নির্দোষ বলতে চাই না। নিশ্চয়ই মানুষের প্রবৃত্তি মন্দের প্ররোচনা দেয়, কেবল ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইউসুফ ১২/৫৩)।
ক. ইহতিসাব অন্তরের মরিচা দূর করে :
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِن الْمُؤْمِنَ إِذَا أَذْنَبَ كَانَتْ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فِي قَلْبِهِ فَإِنْ تَابَ وَاسْتَغْفَرَ صُقِلَ قَلْبُهُ وَإِنْ زَادَ زَادَتْ حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ فَذَلِكُمُ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللهُ تَعَالَى : كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يكسِبونَ- ‘বান্দা যখন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। অতঃপর যখন সে গুনাহের কাজ পরিহার করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তওবা করে তখন তার অন্তর পরিষ্কার ও দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়’।[3] আর এটাই সেই মরিচা যা আল্লাহ বর্ণনা করেছেন,كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘কখনই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’ (মুত্বাফ্ফিফীন ৮৩/১৪)।
সুতরাং গুনাহের কাজ করলে হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। আর তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَآئِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ- ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কুমন্ত্রণা স্পর্শ করার পর তারা সচেতন হয়ে যায় এবং তারা সঠিক পথ দেখতে পায়’ (আ‘রাফ ৭/২০১)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুৎবায় বলতেন,وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، ‘আমরা আল্লাহর নিকট আমাদের মনের কুমন্ত্রণা ও মন্দকর্ম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।[4]
খ. কর্ম অনুযায়ী ফলাফল পাবে :
আখেরাতে প্রত্যেক মানুষ স্ব স্ব কর্ম অনুযায়ী ফলাফল প্রাপ্ত হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَآءَ فَعَلَيْهَا وَمَا رَبُّكَ بِظَلاَّمٍ لِّلْعَبِيدِ- ‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, সে তার নিজের জন্যই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি অসৎকর্ম করে তার প্রতিফল তার উপরেই বর্তাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক তার বান্দাদের প্রতি যুলুমকারী নন’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৬; জাছিয়াহ ৪৫/১৫)।
তিনি আরও বলেন,وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ أُخْرَى ثُمَّ إِلَى رَبِّكُمْ مَرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ- ‘একে অপরের বোঝা বহন করবে না। পরিশেষে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে’ (আন‘আম ৬/১৬৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَآئِرَهُ فِي عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَّلْقَاهُ مَنْشُورًا- اِقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْبًا- ‘প্রত্যেক মানুষের আমলনামা আমরা তার গর্দানে রেখেছি। আর ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি কিতাব, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে’ (১৩)। ‘পাঠ কর তোমার আমলনামা। তুমি আজ নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৩-১৪)।
তিনি আরও বলেন,وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَاوَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لاَ يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَّلاَ كَبِيرَةً إِلاَّ أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَّلاَ يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا- ‘অতঃপর আমলনামা পেশ করা হবে। তখন তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় আফসোস! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কোন কিছুই ছাড়েনি, সবকিছুই গণনা করেছে? আর তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কাউকে যুলুম করেন না’ (কাহ্ফ ১৮/৪৯)।
আল্লাহ বলেন,يَوْمَئِذٍ يَّصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ- فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَھ۫- وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَھ۫- ‘সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যেন তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সমূহ দেখানো যায়। অতঃপর কেউ বিন্দু পরিমাণ ভাল কাজ করলেও তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ বিন্দু পরিমাণ মন্দ কাজ করলেও তা সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৬-৮)।
তিনি বলেন,فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ- فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَّاضِيَةٍ- وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ- فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ- ‘অতঃপর যার নেকীর পাল্লা ভারি হবে, সে জান্নাতে সুখী জীবন যাপন করবে। আর যার নেকীর পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাভিয়াহ জাহান্নাম’ (ক্বারি‘আহ ১০১/৬-৯)।
ঘ. আত্মসমালোচনা না করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে :
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ছাহাবীদের বলেন,أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَّ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُّقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ- ‘তোমরা কি জানো, নিঃস্ব কোন ব্যক্তি? সবাই বলল, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যার কোন টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নেই। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে ক্বিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি নিঃস্ব, যে ছালাত-ছিয়াম-যাকাত ইত্যাদি আদায় করে আসবে। সাথে সেসব লোকেরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, কাউকে হত্যা করেছে বা কাউকে প্রহার করেছে। তখন ঐসব পাওনাদারকে ঐ ব্যক্তির নেকী থেকে পরিশোধ করা হবে। এভাবে পরিশোধ করতে করতে যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তখন ঐসব লোকদের পাপসমূহ এই ব্যক্তির উপর চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[5]
সেজন্য রাসূল (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে বলেন,مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لِّأَحَدٍ مِّنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَّ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ- إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، وَإِنْ لَّمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ- ‘যদি কেউ তার ভাইয়ের মানহানি করে বা অন্য কোন বিষয়ে তার প্রতি অবিচার করে, তবে সে যেন আজই তা মিটিয়ে নেয়; সেদিন আসার আগে, যেদিন কোন দীনার ও দিরহাম তার সঙ্গে থাকবে না। সেদিন যদি তার কোন নেক আমল থাকে, তবে তার যুলুম সমপরিমাণ নেকী সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি তার কাছে নেকী না থাকে, তবে মযলূম ব্যক্তির পাপ সমূহ যালেমের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’।[6]
পরকালে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا- أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَآئِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلاَ نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا- ذَلِكَ جَزَاؤُهُمْ جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوا وَاتَّخَذُوا آيَاتِي وَرُسُلِي هُزُوًا- ‘বলে দাও, আমরা কি তোমাদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে জানিয়ে দেব?’ (১০৩) ‘তারা হ’ল সেই সব লোক যাদের সকল প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিফলে গেছে। অথচ তারা ভেবেছে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (১০৪)। ‘ওরা হ’ল তারাই, যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত সমূহকে এবং তার সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের সকল কর্ম নিস্ফল হয়ে গেছে। ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাদের জন্য মীযানের পাল্লা খাড়া করব না’ (১০৫)। ‘জাহান্নামই তাদের প্রতিফল। কেননা তারা অবিশ্বাসী হয়েছে এবং আমার আয়াত সমূহকে ও আমার রাসূলদেরকে ঠাট্টার বস্ত্তরূপে গ্রহণ করেছে’ (কাহ্ফ ১৮/১০৩-১০৬)।
ঘ. আত্মসমালোচনাকারী সর্বাধিক বিচক্ষণ ব্যক্তি : পরকালে সর্বাধিক লাভবান হিসাবে সর্বাধিক বিচক্ষণ ব্যক্তি সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,كُنْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَجَآءَهُ رَجُلٌ مِّنَ الأَنْصَارِ فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِىِّ-صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ثُمَّ قَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ أَىُّ الْمُؤْمِنِيْنَ أَفْضَلُ قَالَ : أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا. قَالَ فَأَىُّ الْمُؤْمِنِيْنَ أَكْيَسُ قَالَ : أَكْثَرُهُمْ لِلْمَوْتِ ذِكْرًا وَأَحْسَنُهُمْ لِمَا بَعْدَهُ اسْتِعْدَادًا أُولَئِكَ الأَكْيَاسُ- ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে সালাম করল। অতঃপর জিজ্ঞেস করল, কোন মুমিন সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘যে সবচেয়ে চরিত্রবান’। লোকটি বলল, কে সবচাইতে বিচক্ষণ? তিনি বললেন, ‘যে মৃত্যুকে সর্বাধিক স্মরণকারী এবং তার পরবর্তী জীবনের জন্য সর্বাধিক সুন্দর প্রস্ত্ততি গ্রহণকারী। তারাই হ’ল বিচক্ষণ’।[7]
আত্মসমালোচনার বিষয়বস্ত্ত
কোন কোন বিষয়ে আত্মসমালোচনা করা বিশেষ যরূরী, তা নির্ণয় করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেমন-
ক. পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত :
অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত নিয়মিত পড়া হয়েছে কি না আর হ’লে জামাআতে হয়েছে কি না- এ বিষয়ে নিজেকে সর্বদা জবাবদিহীর মধ্যে রাখতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ وَالْجُمُعَةُ إِلَى الْجُمُعَةِ وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ مُكَفِّرَاتٌ لَمَّا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتُنِبَتِ الْكَبَائِر، رَوَاهُ مُسلم- ‘পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুম‘আ থেকে আরেক জুম‘আ এবং এক রামাযান থেকে আরেক রামাযানের মধ্যকার যাবতীয় ছগীরা গুনাহের কাফফারা হয়, যদি সে কবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে বিরত থাকে’।[8]
খ. কুরআন তেলাওয়াত : আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الْغَافِلِينَ وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْقَانِتِينَ وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْمُقَنْطَرِينَ- ‘যে ব্যক্তি রাতে দশটি আয়াত পড়বে তার নাম গাফেলদের তালিকায় লেখা হবে না। আর যে রাতে একশত আয়াত পড়বে তার নাম ‘ক্বানিতুন’ বা অনুগতদের তালিকায় লেখা হবে। আর যে এক হাযার আয়াত পড়বে তাকে ‘মুক্বানত্বারূন’ বা প্রাচুর্যশীলদের তালিকাভুক্ত করা হবে’।[9]
গ. নফল ইবাদত : হযরত উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া (রাঃ) বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীছ-
خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا بُكْرَةً حِينَ صَلَّى الصُّبْحَ وَهِىَ فِى مَسْجِدِهَا ثُمَّ رَجَعَ بَعْدَ أَنْ أَضْحَى وَهِىَ جَالِسَةٌ فَقَالَ مَا زِلْتِ عَلَى الْحَالِ الَّتِى فَارَقْتُكِ عَلَيْهَا. قَالَتْ نَعَمْ. قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لَقَدْ قُلْتُ بَعْدَكِ أَرْبَعَ كَلِمَاتٍ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ لَوْ وُزِنَتْ بِمَا قُلْتِ مُنْذُ الْيَوْمِ لَوَزَنَتْهُنَّ سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ عَدَدَ خَلْقِهِ وَرِضَا نَفْسِهِ وَزِنَةَ عَرْشِهِ وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ-
‘একদিন ফজর ছালাত শেষে ভোর বেলায় নবী করীম (ছাঃ) ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তিনি তখন তাঁর মুছল্লায় বসা অবস্থায় ছিলেন। পূর্বাহ্ন হওয়ার পর নবী করীম (ছাঃ) যখন ফিরে আসলেন তখনও তিনি বসা অবস্থায় ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি যে অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে গেছি তুমি সে অবস্থায়ই আছো? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি যদি ফজর ছলাতের পরে চারটি বাক্য তিনবার বলতে তবে তা তোমার আজকের সারা দিনের বলা সকল কথার সমতুল্য হ’ত। সেই বাক্য চারটি হল : সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী ‘আদাদা খালক্বিহী, ওয়া রিযা নাফসিহী, ওয়া যিনাতা আরশিহী, ওয়া মিদাদা কালিমাতিহী। অর্থাৎ আমি আল্লাহর প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা করছি তার সৃষ্টিকুলের সংখ্যার সমপরিমাণ; তাঁর নিজের সন্তুষ্টির সমপরিমাণ; তাঁর আরশের ওযন পরিমাণ এবং তার বাক্য সমূহের সংখ্যার সমপরিমাণ’।[10]
ঘ. পারিবারিক তা‘লীম : নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে হবে এবং পরিবারকেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে হবে। এজন্য প্রতি সপ্তাহে পারিবারিক তা‘লীমের বিকল্প নেই। আল্লাহ বলেন, يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوآ أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’ (তাহরীম ৬৬/৬)।
সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِى بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِى فِى امْرَأَتِكَ- وفى رواية حَتَّى اللُّقْمَةَ تَجْعَلُهَا فِى فِى امْرَأَتِكَ- ‘তুমি যা কিছুই ব্যয় কর না কেন, তাতে যদি তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা কর, তাহ’লে তুমি সেজন্য ছওয়াব পাবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমা তুলে দাও সেজন্যও’।[11]
ঙ. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় : প্রতিদিন কিছু না কিছু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ- ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর এবং কার্পণ্যবশতঃ নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর তোমরা সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন আল্লাহ বলেন, أَنْفِقْ يَا ابْن آدم أنْفق عَلَيْك- ‘হে আদম সন্তান! (আমার রাস্তায়) ব্যয় কর, আমি তোমার জন্য ব্যয় করব’।[12]
আত্মসমালোচনার উপকারিতা
ক. আল্লাহভীতি অর্জন করা : ‘ইহতিসাব’ বা আত্মসমালোচনা মুমিন জীবনকে আল্লাহর পথে পরিচালনা করতে সহায়তা করে। সে সর্বদা নিজের পাপের কারণে আল্লাহ ভয়ে ভীত থাকে। কেননা পৃথিবীর সমস্ত কিছুই তার পাপের সাক্ষী হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহর বাণী-
১. إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولاً- ‘নিশ্চয়ই তোমার কর্ণ, চক্ষু ও বিবেক প্রতিটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৬)।
২. তার নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। যেমন আল্লাহ বলেন, اَلْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَآ أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُون- ‘আজ আমরা তাদের মুখে মোহর মেরে দেব। আর আমাদের সাথে কথা বলবে তাদের হাত এবং সাক্ষ্য দিবে তাদের পা, (দুনিয়াতে) যা তারা উপার্জন করেছিল সে বিষয়ে’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৫)।
৩. তার দেহচর্ম ও ত্বক সাক্ষ্য দিবে। আল্লাহ বলেন, حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ- وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُونَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلَا أَبْصَارُكُمْ وَلَا جُلُودُكُمْ وَلَكِنْ ظَنَنْتُمْ أَنَّ اللَّهَ لَا يَعْلَمُ كَثِيرًا مِمَّا تَعْمَلُونَ- وَذَلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِي ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ أَرْدَاكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ مِنَ الْخَاسِرِينَ- فَإِنْ يَصْبِرُوا فَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ وَإِنْ يَسْتَعْتِبُوا فَمَا هُمْ مِنَ الْمُعْتَبِينَ- ‘অবশেষে যখন তারা জাহান্নামের নিকটে এসে যাবে, তখন তাদের কান, চোখ ও ত্বক তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবে’। ‘তখন তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ কেন? তারা বলবে, আল্লাহ আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন। যিনি সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে’। ‘তোমাদের কান, চোখ ও ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবেনা ভেবেই তোমরা তাদের কাছ থেকে কিছুই গোপন করতে না। বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না’। ‘তোমাদের পালনকর্তা সম্পর্কে তোমাদের এই ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছ’। ‘অতঃপর যদি তারা ছবর করে, তবু জাহান্নামই তাদের ঠিকানা। আর যদি তারা অনুতপ্ত হয়, তবু তাদের ওযর কবুল করা হবে না’ (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত ৪১/২০-২৪)। ।
৪. এমনকি যে মাটিতে সে বিচরণ করত, সে মাটিও তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। আল্লাহ বলেন,إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا- وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا- وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا- يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا- بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا- ‘যখন পৃথিবী তার চূড়ান্ত কম্পনে প্রকম্পিত হবে, যখন ভূগর্ভ তার বোঝাসমূহ বের করে দেবে এবং মানুষ বলবে, এর কি হ’ল? সেদিন পৃথিবী তার সকল বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কেননা তোমার পালনকর্তা তাকে প্রত্যাদেশ করবেন’ (যিলযাল ৯৯/৪-৫)। উপরোক্ত আয়াতে কারীমা সমূহ কোন মুমিন যদি সর্বদা স্মরণে রেখে আত্মসমালোচনায় ব্রতী হয়, তবে তার জীবনকে আল্লাহর পথে পরিচালনা করতে সেটি সহায়তা করবে ইনশাআল্লাহ।
খ. পাপকর্ম হয়ে গেলেও সৎকর্ম অব্যাহত রাখা : ভুলক্রমে হলে প্রায়শ্চিত্যস্বরূপ সে সৎকর্ম করতে অভ্যস্ত হয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذَالِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِيْنَ- ‘নিশ্চয়ই ভালকাজ মন্দকাজকে দূর করে দেয়, আর এটা স্মরণকারীদের জন্য স্মরণ’ (হূদ ১১/১১৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا- ‘তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর। কোন পাপ কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে সাথে সাথে সৎআমল কর যাতে তা মিটে যায়’।[13]
গ. বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার :
১. আল্লাহ বলেন,وَتُوبُوآ إِلَى اللهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- ‘তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে আস, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)।
২. তিনি অন্যত্র নূহ (আঃ)-এর প্রসঙ্গে বলেন,فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا- يُرْسِلِ السَّمَآءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا- وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَّبَنِينَ وَيَجْعَلْ لَكُمْ جَنَّاتٍ وَّيَجْعَلْ لَكُمْ أَنْهَارًا- ‘আমি তাদের বলেছি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি বড়ই ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘমালা প্রেরণ করবেন। তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন এবং তোমাদের জন্য বাগান সমূহ সৃষ্টি করবেন ও নদী সমূহ প্রবাহিত করবেন’ (নূহ ৭১/১০-১২)।
৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّهُ لَيُغَانُ عَلَى قَلْبِي، وَإِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللهَ، فِي الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ، رواه مسلم- ‘আমার অন্তরের উপর কখনো পর্দা ফেলা হয়। আর আমি দৈনিক একশত বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি’।[14] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দৈনিক ৭০ বারের অধিক, অন্য বর্ণনায় ১০০ বার করে তওবার দো‘আ পাঠ করতেন’।[15]
৪. তওবার দো‘আ :أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِى لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ- ‘আমি আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক। আর আমি তাঁর দিকেই ফিরে যাচ্ছি’। এই দো‘আ পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন...’।[16]
উপসংহার : আল্লাহ আমাদেরকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে দূরে থেকে সঠিক পদ্ধতিতে আমলে ছালেহ সম্পাদন করে আত্মিক পরিশুদ্ধিতার জন্য নিয়মিত আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত হওয়ার তাওফীক দান করুন। সেই সাথে ক্বিয়ামতের দিন ডান হাতে আমালনামা দিয়ে আমাদেরকে জান্নাত লাভে ধন্য করুন- আমীন!
[লেখক : কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ); গৃহীত : ইহতিসাব, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ‘ভূমিকা’ পৃষ্ঠা।
[2]. তিরমিযী হা/২৪৫৯, সনদ মওকূফ ছহীহ।
[3]. আহমাদ হা/৭৯৩৯; তিরমিযী হা/৩৩৩৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪; মিশকাত হা/২৩৪২; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৪১।
[4]. তিরমিযী হা/১১০৫; নাসাঈ হা/১৪০৪; ইবনু মাজাহ হা/১৮৯২-৯৩; মিশকাত হা/৩১৪৯।
[5]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭।
[6]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯; ছহীহাহ হা/১৩৮৪।
[8]. মুসলিম হা/২৩৩; মিশকাত হা/৫৬৪।
[9]. আবুদাঊদ হা/১৩৯৮; মিশকাত হা/১২০১; ছহীহাহ হা/৬৪২।
[10]. মুসলিম হা/২৭২৬; মিশকাত হা/২০৩১।
[11]. বুখারী হা/৫৬, ৪৪০৯; মুসলিম হা/১৬২৮।
[12]. বুখারী হা/৫৩৫২; মুসলিম হা/৯৯৩ (৩৬); মিশকাত হা/১৮৬২।
[13]. তিরমিযী হা/১৯৮৭; মিশকাত হা/৫০৮৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৬০।
[14]. মুসলিম হা/২৭০২; মিশকাত হা/২৩২৪।
[15]. বুখারী হা/৬৩০৭; মুসলিম হা/২৭০২; মিশকাত হা/২৩২৩-২৪।
[16]. আবুদাঊদ হা/১৫১৭; মিশকাত হা/২৩৫৩।