দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি : বিপর্যস্ত জনজীবন

আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক 735 বার পঠিত

দ্রব্যমূল্য এক লাগামহীন পাগলাঘোড়া। যার লাগাম টেনে ধরা যেনো এক দুঃসহ যাতনা। করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন এ উর্ধ্বগতি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে করোনা সংক্রমণ ঠেকানো গেলেও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে রীতিমতো সবাই অসহায়। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলায় ভরপুর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এক সময় ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি লাভ করেছিল। মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বাংলাকে বিশেষায়িত করেছিলেন সম্পদপূর্ণ হীরক হিসাবে।

আজ সে বাংলা নানা সমস্যায় জর্জরিত। করোনা ধাক্কা সামাল দিতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের, সেখানে বিনা দাওয়াতেই নতুন মেহমান এসে হাযির। মেহমানের নাম খাদ্যদ্রব্যের অগ্নিমূল্য। চাল-ডাল, মাছ-মাংস, তেল, তরি-তরকারী, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা ইত্যাদি দ্রব্যমূল্য দফায় দফায় যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মধ্যবিত্তের জন্য নাভিশ্বাস উঠার দশা।

মুদ্রাস্ফীতি বলতে আসলে কি বুঝায়?

সহজ ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বলতে বুঝি মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া। পণ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে একই টাকায় আপনি গতবছরের তুলনায় কম দ্রব্য কিনতে পারবেন। একটি উদাহরণ দেয়া যাক-ধরুন আপনি আজ ১০০ টাকা দিয়ে একটি স্যান্ডউইচ কিনলেন। বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ১০%। ফলে পরের বছর একই স্যান্ডউইচ ক্রয় করতে আপনার খরচ পড়বে ১১০ টাকা। ফলশ্রুতিতে এভাবেই আয় সমান থাকা সত্ত্বেও আমাদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ সমূহ অনুসন্ধান করলে যা বেরিয়ে আসে তা হ’ল :

১. মাফিয়া সিন্ডিকেট : রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সেক্টর মূলত বিভিন্ন সিন্ডিকেট মাফিয়াদের করতলগত। এক শ্রেণীর অসাধু চক্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। স্বয়ং সরকারও এদের হাতে জিম্মি থাকে।

২. আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব : দ্রব্যসামগ্রী আন্ত-সম্পর্কিত হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে দেশীয় বাজারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো দ্রব্যের দাম কমলে দেশীয় বাজারে তা কমে না। বরং অতিরিক্ত মুনাফা তৃতীয় পার্টির পকেটে চলে যায়।

৩. ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী : একটি পণ্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পেŠঁছাতে গিয়ে যতবার হাতবদল হয় ততবার তার নতুন দাম নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন দালাল এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের এই অপতৎপরতার কারণে একদিকে যেমন কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পায় না অন্যদিকে ভোক্তাদেরকেও চড়ামূল্যে দ্রব্য ক্রয় করতে হয়।

৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : মানুষের কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ বিভিন্ন সময় আল্লাহ প্রদত্ত দূর্যোগ নেমে আসে। ‘স্থলে ও জলে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে মানুষের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ’(রূম ৪১/৩০)

অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির ফলে দ্রব্যের উৎপাদন তথা যোগান কমে যায়। আর মোট যোগানের তুলনায় চাহিদা বেশী হ’লে পণ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির চিরায়ত নিয়ম।

৫. চাঁদাবাজি : মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অংকের চাঁদা ধার্য করা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। তাছাড়া বিভিন্ন সেতু ও মহাসড়কের ঘাটে ঘাটে টোল প্রদান করার কারণে পণ্যদ্রব্যের পরিবহন খরচ বৃহদাংশে বৃদ্ধি পায়।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামের এমন সব কালজয়ী কল্যাণধর্মী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে যা বাস্তবায়িত হলে অনায়াসে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি রোধ করা সম্ভব।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উপরোক্ত কারণসমূহ সমাধানে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল-

প্রথমতঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে কারো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণকারী হ’লেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ‘লা। মূলতঃ বান্দার চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে তিনি দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে থাকেন। তিনিই একমাত্র সংকীর্ণতা, প্রশস্ততা আনয়নকারী এবং রিযিকদাতা।

তবে যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অন্যায়ভাবে কারসাজি করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, এক্ষেত্রে সরকারের উপর কর্তব্য হচ্ছে বাজার হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্যের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করে দেয়া। ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও যদি পণ্যের মালিকগণ প্রচলিত দামের চেয়ে বেশী মূল্যে বিক্রয় করে, তখন তাদেরকে প্রচলিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য করা ওয়াজিব (আল হিসবাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ১৯-২০)।

ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন, মানুষের মধ্যে ন্যায় এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ শুধু বৈধই নয় ক্ষেত্রবিশেষে যরূরীও বটে’ (আত-তুরুক, ১/৩৫৫ পৃ.)

দ্বিতীয়তঃ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলাম মজুদদারিতা নিষিদ্ধ করেছে। যে ব্যক্তি (সংকট তৈরী করতে) খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী।

তবে গুদামজাত পণ্য যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় হয় কিংবা চাহিদার অতিরিক্ত হয় তাহলে পণ্য মজুদ রাখা অবৈধ নয়।

তৃতীয়তঃ ফড়িয়া এবং দালালরা অপতৎপরতার মাধ্যমে যেন দাম বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য রাসূল (ছাঃ) গ্রামবাসীর পক্ষ হতে অন্য কাউকে দ্রব্য বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। আনাস বিন মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে যে, শহরের লোক যেন গ্রামের লোকের পক্ষ হয়ে বিক্রয় না করে’ (মুসলিম ৩৬৮৭)

চতুর্থতঃ উর্ধ্বগামী মূল্যের জিনিস পরিহার করা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অন্যতম একটি উপায়। ওমর (রাঃ)-এর যুগে লোকেরা এসে তার নিকট গোশতের মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ করে। তখন তিনি বললেন ‘তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও’। তখন লোকেরা বলল যে, ‘আমরা কি গোশতের মালিক যে এর মূল্য কমিয়ে দিব? তখন তিনি বললেন, ‘তাদের নিকট থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও’(আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া)।

পঞ্চমতঃ অল্পে তুষ্টি এবং অপচয় রোধ। মুমিনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জিহ্বাকে কথা বলার সময় যেমন সংযত রাখে, তেমনি খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমার ভাগ্যে আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাতে খুশী থাকলে তুমি হবে সবচেয়ে সুখী মানুষ’ (তিরমিযী হা/২৩০৫)। অন্যদিকে অপচয় সর্বদা বর্জনীয়। কেননা এটি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং খাদ্য সংকটের একটি পরোক্ষ কারণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালোবাসেন না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)

পরিশেষে শুধু এতটুকুই বলব, ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত শাশ্বত জীবন বিধান। মানব রচিত কোন বিধান নয় বরং আল্লাহর বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার মাধ্যমেই মানবতার মুক্তি নিহিত। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আর এ সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী অর্থব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবী।

[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও