শামসুল আলম (যশোর) (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 2050 বার পঠিত
[‘আহলেহাদীছ
আন্দোলন বাংলাদেশ’ পরিচালিত আহলেহাদীছ ইমাম ও ওলামা সমিতি-এর সম্মানিত
সহ-সভাপতি শায়খ আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী (পাবনা)। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ
যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক
সমাজ গঠনে বিরামহীনভাবে দাওয়াতী কাজ করে যাচ্ছেন। মদীনা ইসলামী
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ বিভাগ থেকে লিসান্স ডিগ্রী গ্রহণ করা এই আলেমে
দ্বীনের একনিষ্ঠ দাওয়াত জনসাধারণকে বিশুদ্ধ আমল-আখলাক গঠনে ব্যাপকভাবে
উদ্বুদ্ধ করেছে। কর্মজীবনে তিনি খত্বীব ও দাঈ হিসাবে দেশে এবং বাহরাইনে
ইসলামী দাওয়াহ সেন্টারে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি পীস টিভি বাংলার
আলোচক হিসাবে মনোনীত হন। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের নানা দিক ও বিভাগ সম্পর্কে
জানার জন্য আলোচ্য সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাক-এর নির্বাহী
সম্পাদক ড. মুখতারুল ইসলাম ও ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক
আব্দুন নূর। সাক্ষাৎকারটি তাওহীদের ডাক পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।]
তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই।
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : আমার জন্ম সাল সঠিকভাবে জানা নেই। তবে আনুমানিক ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে হতে পারে। এ বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতা না বললেই নয়। মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বয়স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। আমি বললাম, আমার কাগজে লেখা আছে। তিনি বললেন, কেন তোমার পিতা-মাতা জানাননি? আমি বললাম, আমার অভিভাবকরা জানে যে, আমার উস্তাযরা লিখে রেখেছেন। উনি এবার বললেন, তোমার আসল বয়সটা কত? আমি তো বলতেই চাইলাম না। শেষ পর্যন্ত উনি বললেন যে, তোমার দেশে নাকি বাপ আর বেটা একই বছরে জন্মগ্রহণ করে? আমি বললাম, বাপ এবং বেটা যদি একই বছরে দাখিল পরীক্ষা দেয়, তাহ’লে তো একই জন্ম সাল হবে। যাই হোক সার্টিফিকেট অনুযায়ী জন্মসাল ১লা জানুয়ারী ১৯৭২ সাল। আমার জন্ম পাবনার দোগাছীতে, মুকুন্দপুর গ্রামে।
তাওহীদের ডাক : আপনার পিতা-মাতা ও পরিবার সম্পর্কে যদি বলতেন?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : আমার পিতার নাম ইসমাঈল হুসাইন প্রামাণিক। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, ইমাম ও খত্বীব ছিলেন। আমার মায়ের নাম হালীমা বিনতে ইয়াকূব। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিণী। আমাদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবার তুলনায় মায়ের অবদান অনেক বেশী। পিতা-মাতা উভয়েই মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের খুবই ভক্ত ছিলেন। আববা মৃত্যুর আগে আমীরে জামা‘আতের বিশেষ দো‘আ পেয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। বাবার জানাযা আমীরে জামা‘আত স্বয়ং পড়িয়েছিলেন আর মহিলাদের নিয়ে আমি একটা জানাযা পড়েছিলাম। আর আম্মা মারা গেলে আমীরে জামা‘আত যেতে পারেননি। তবে তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন।
আমার প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। সেখানে ৩ ছেলে আর ৩ মেয়ে আছে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আমার নতুন পরিবারে একটিমাত্র কন্যা সন্তান আল্লাহ পাক দান করেছেন। বর্তমানে তার বয়স দুই বছর।
আমার প্রথম পক্ষের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মারকাযের সাবেক ছাত্র শরীফুল ইসলাম বিন আব্দুছ ছামাদ (গাইবান্ধা)-এর সাথে। ২য় মেয়েটার বিয়ে দেওয়া হয়েছে সঊদী আরবের রিয়াদে কর্মরত এক ছেলের সাথে। তৃতীয় মেয়ে নওদাপাড়া মারকাযে লেখাপড়া করছে।
আমার বড় ছেলে আনাস এবং মেঝ আম্মার ছেলে এই মারকায থেকেই ছানাবিয়া শেষ করেছে। আর ছোট ছেলে আকীল বর্তমানে ঢাকার একটি মাদ্রাসার হিফযখানায় পড়ছে।
তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষা জীবন ও পড়াশোনা কিভাবে শুরু হয়েছিল?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : আমি কৃষকের ছেলে হওয়ায় আমার শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল একটু দেরীতে। আমি সাংসারিক কৃষি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। গরু, ছাগল পালতাম। এক সময় গ্রামের লোকেরা আমার আববাকে বলল, আপনার এ ছেলেটাকে মাদ্রাসায় দেয়া উচিত। অবশেষে আমার বাবা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রথম দিকে আমি পড়তে যেতে চাইনি। ফলে তিনি আমাকে খুব শাসন করেছিলেন। পড়াশুনা শুরু হ’লে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে হবে কারণ বয়স বেশী হয়ে গেছে। এভাবে আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পাবনা খয়েরসূতী দারুল হাদীছ রহমানিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করি। এরপর মুরুববীদের পরামর্শে আল্লামা কাফী ছাহেবের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা বাঁশবাজার, পাবনায় ভর্তি হই। তখন আমার বয়স আনুমানিক ১৭/১৮ বছর হবে।
কওমী মাদ্রাসায় পড়া চলাকালীন সময়েই দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমি জমঈয়তের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হই। আর ফাঁকে ফাঁকে আলিম, ফাযিল, কামিল পরীক্ষা শেষ করি। কওমী মাদ্রাসা থেকে আমি ১৯৯০ সালে দাওরায়ে হাদীছ শেষ করেছিলাম। মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক প্রফেসর ড. যায়েদ বিন গানেম আল-জুহানীর নিকট সরাসরি সাক্ষাৎকার দিয়ে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং সেখান থেকে হাদীছ বিষয়ে ফারেগ হই। ফালিল্লাহিল হামদ!
তাওহীদের ডাক : আপনি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর সাথে শুরুকাল থেকে যুক্ত। কিভাবে এই সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : ‘যুবসংঘে’ আসার পূর্বেই আমার কিছু স্মৃতিকথা আছে। আমি ঢাকাতে যাওয়ার আগে বেশ কিছুদিন ইলিয়াছী তাবলীগের সাথে জড়িত ছিলাম। তাদের প্রদত্ত ছয়টি উছূল আজও আমার মুখস্থ আছে। তাবলীগ জামাতের সাথে চলাফেরা, কাকরাইল মসজিদে রাত্রি যাপন, তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ সবই এখন স্মৃতি। পরবর্তীতে আমি ঢাকায় যাওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িয়ে পড়ি। তাদের কোন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন না করলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতাম ও তাদেরকে ভালবাসতাম। একবার কাকরাইল যেতাম আবার জামায়াতের বিভিন্ন প্রোগ্রামে যেতাম।
১৯৮৬ সালের দিকে হঠাৎ একদিন আমীরে জামা‘আতের বক্তব্য শুনি এবং তাঁর মুখে আহলেহাদীছদের সাথে অন্যদের মৌলিক পার্থক্য জানতে পারি। আমাদের সাথে তাদের আমলের গরমিল আছে সেটা আমি বুঝতে পারি। পরবর্তীতে আমীরে জামা‘আত ‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ এবং ‘তিনটি মতবাদ’ নামক যুগান্তকারী দু’টি বই লিখলেন। এই বই দু’টি আমার চোখ খুলে দিল। আমি প্রত্যেক ভাইকে বলব, এই বই দু’টি ভালভাবে পড়তে। শুধু তাই নয়, আমীরে জামা‘আতের সবগুলো বই ভাল করে পড়ার অনুরোধ থাকবে। এক শ্রেণীর মানুষ দ্বীনকে দুনিয়া থেকে আলাদা করেছে এবং আরেক শ্রেণীর মানুষ রাজনীতির নামে দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিকে গুলিয়ে ফেলেছেন। এই বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করবে যে, আমরা কি আন্দোলন করছি আর তারা কি আন্দোলন করছে। এই গোলকধাঁধা থেকে পরিষ্কার একটি ধারণা এই বইগুলো থেকে পাওয়া যাবে। বিশেষতঃ আমীরে জামা‘আতের ‘তিনটি মতবাদ’ বইয়ের বিকল্প কোন বই আমার চোখে পড়ে না। সুতরাং এভাবেই যুবসংঘের ছায়াতলে আসার সুযোগ পেলাম। ফালিল্লাহিল হামদ।
তাওহীদের ডাক : আপনি যুবসংঘে’র প্রাক্তন কর্মী হিসাবে সংগঠনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালের সাক্ষী ছিলেন। সেই জায়গা থেকে যুবসংঘের সূচনা এবং পরবর্তীকালের ইতিহাস যদি বিস্তারিত বলতেন?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : সব কিছু ছেড়ে আমি যখন ‘যুবসংঘ’-এর কাজকর্ম শুরু করলাম, এক পর্যায়ে আমি ঢাকা যেলার প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হ’ল আমাকে। তখন বৃহত্তর ঢাকা যেলার ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী এই অঞ্চলে আমি তাবলীগ বা প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতাম। তখন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছ ছিল একক সংগঠন। ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ সকলের একটাই প্লাটফর্ম। আমীরে জামা‘আত বুঝতে পারলেন যুবকরা সব মিসগাইডেড হয়ে যাচ্ছে। যুবকদের জন্য একটা আলাদা প্লাটফর্ম প্রয়োজন। আর এরই সুবাদে ‘যুবসংঘে’র সূচনা হয়। তৎকালীন জমঈয়ত সভাপতি প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আব্দুর বারী (রহঃ) কাছে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত যুবকদের নিয়ে আলাদা একটি প্লাটফর্মের প্রস্তাব পেশ করেন। তখন তিনি মৌখিকভাবে যুবকদের জন্য ‘যুবসংঘ’ গঠন করার অনুমতি দেন এবং এটাকে তদারকি করার জন্য তৎকালীন জমঈয়ত সেক্রেটারী জনাব আব্দুর রহমান বিএবিটি (রহঃ)-কে পাঠানো হয়। মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া সংলগ্ন মসজিদে ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ৬৪ জন অ্যাডহক সদস্য নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। অ্যাডহক কমিটিতে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে আহবায়ক এবং যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা দেওয়ান হাসান শহীদ (টাঙ্গাইল)-কে যুগ্ম আহবায়ক করা হয়।
তন্মধ্যে বর্তমানে ‘আহলেহাদীছ তাবলীগে ইসলাম’-এর সাথে জড়িত আমার উস্তায মাওলানা শামসুদ্দীন সিলেটীও এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর গঠনতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি জমঈয়তে আহলেহাদীসের প্রেস ‘আল-হাদীস প্রিন্টিং প্রেস এন্ড পাবলিশিং হাউস’ ৯৮ নওয়াবপুর রোড থেকে ছাপা হয়। যেসব ভাইয়েরা বলেন যে, যুবসংঘ আলাদা হয়েছে, দল গঠন করেছে, এই করেছে, সেই করেছে- সে সব ভাইদের প্রতি আমাদের অনুরোধ যে আপনারা ইতিহাসটা পড়ুন এবং জানার চেষ্টা করুন। জমঈয়ত সভাপতি ড. আব্দুল বারী (রহঃ) স্বয়ং ‘যুবসংঘে’র অনুমোদন দেওয়ার পর তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আব্দুর রহমান বিএবিটি ছাহেবকে প্রেরণ করলেন। তাঁর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জমঈয়ত কর্তৃক পরিচালিত মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদেই ‘যুবসংঘ’-এর কমিটি গঠন করা হ’ল এবং জমঈয়তের প্রিন্টিং প্রেস থেকেই প্রথম গঠনতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি ছাপা হ’ল। ছাপা হওয়ার পরেই তো ‘যুবসংঘ’-এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
যুবসংঘের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর মিলনায়তনে আয়োজিত ‘তাওহীদের শিক্ষা ও আজকের সমাজ’ শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র হানিফ ছাহেবের শ্বশুর এবং মেয়র সাঈদ খোকনের নানা আব্দুল মাজেদ সরদার। যার নামে মাজেদ সরদার লেন নামে বংশালে রাস্তা রয়েছে। সেই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীসের সভাপতি ড. আব্দুল বারী (রহঃ)। প্রধান অতিথি আমাদের আমীরে জামা‘আত এবং বিশেষ অতিথি ‘যুবসংঘে’র উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, যিনি জমঈয়তে আহলেহাদীসের কেন্দ্রীয় পরিষদের দায়িত্বশীল ছিলেন, শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী (ভারত)।
আপনারা শুনলে আশ্চর্য হবেন, ‘যুবসংঘে’র প্রথম সম্মেলন যেদিন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেদিন আমীরে জামা‘আতের দাবীর প্রেক্ষিতে বায়তুল মুকাররম মসজিদের গেটে ঝুলানো আব্দুল কাদের জিলানীর মাযারের গেলাফ, যা ইরাক সফরে গিয়ে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এনেছিলেন, তা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। অথচ সেখানে রীতিমত মানুষের শিরক-বিদ‘আতী কর্মকান্ড শুরু হয়ে গিয়েছিল।
সম্মেলনের দিন বায়তুল মুকাররম মসজিদে এশার আযান মুখে হয়েছিল, মাইকে নয়। কারণ সেদিন মাগরিবের ছালাতে এত জোরে আমীন হয়েছিল যে, এশার আযান মুখে দিয়ে ছালাত পড়ে মসজিদে তালা দিয়ে মসজিদের দায়িত্বশীলরা পালিয়ে ছিল।
এই সম্মেলন হয়ে যাওয়ার পরে কে বা কারা জমঈয়তে আহলেহাদীসের সভাপতি মহোদয় জনাব আব্দুল বারী (রহঃ)-এর কানে কিছু বলল। এরপর থেকে একটা টানাপোড়েন ভাব পরিলক্ষিত হয়। তবে আমি যেটা বুঝেছি সেটা হ’ল জমঈয়তে আহলেহাদীসের গঠনতন্ত্রে লেখা ছিল একক সংগঠন। কিন্তু জমঈয়ত সভাপতির অনুমোদনক্রমে আরেকটি সংগঠন তৈরী হয়ে গেল। কিন্তু তার অনুমোদন করার কোন পথ ছিল না। না থাকার কারণে একটা বিপদ হয়ে গেল। যুবসংঘের অগ্রগতিতে কিছু ঈর্ষা পরায়ণ ব্যক্তিরা জমঈয়তে আহলেহাদীসের সভাপতি মহোদয়কে বুঝাতে লাগলেন তাহ’লে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হোক। ‘যুবসংঘে’র জন্ম ১৯৭৮ সালে আর গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হ’ল জমঈয়তে আহলেহাদীসের ১৯৮৫ সালের কেন্দ্রীয় কনফারেন্সে।
গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে গিয়ে ‘যুবসংঘে’র অনুমোদন না দিয়ে লেখা হ’ল জমঈয়তের ভিতরে অধিক শাখা ও বিভাগ থাকার সুযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে একটা বিভাগ থাকবে শুববান। শুববানকে নতুন বিভাগ হিসাবে অনুমোদন দেওয়া হ’ল। এখন ‘যুবসংঘে’র কী হবে? ‘যুবসংঘে’র তো গঠনতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি এগুলি অলরেডি ছাপা হয়ে গেছে। এখন যুবসংঘ নাকি শুববান- এইভাবে একটা টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল। মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে বানানো হ’ল শুববান বিভাগের পরিচালক। এভাবেই এক পর্যায়ে ‘যুবসংঘে’র সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়া হ’ল এবং একইসাথে অনেক আলেম-ওলামাকে ঐ সময় জমঈয়তে আহলেহাদীস থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তন্মধ্যে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে অব্যাহতি দেওয়া হ’ল। এখন আমাদের বলা হচ্ছে, আমরা নাকি বেরিয়ে গেছি, সংগঠন ভেঙ্গে দিয়েছি। এখন ঐক্যের প্রশ্ন কেউ যদি করে, তাহ’লে সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব থাকবে আপনারা সম্পর্কছেদের এই ঘোষণা পত্রটি পড়ুন ও সত্যটা জানুন।
তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে সরকারী নির্যাতন ও জঙ্গীবাদের অপবাদ এবং এর পিছনে ক্রীড়নক কারা ছিল বলে আপনি মনে করেন?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : এটা তো ওপেন সিক্রেট। এদেশে কথিত বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানকে কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল। তাদের মাধ্যমে সর্বহারা তাড়ানোর নামে প্রকাশ্য দিবালোকে খেজুর আলীকে কেটে টুকরা টুকরা করল। সর্বহারার এক নেতাকে বাগমারার এক স্কুল মাঠে গাছের সাথে লটকিয়ে চাবুকপেটা করল। এটা তো প্রশাসনের সামনেই ঘটল এবং তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফেলল। তারপরে বাংলা ভাইয়ের লোকেরা রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে মিছিল করল। তদান্তীনকালের জোট সরকারের মদদপুষ্ট হয়েই তো এতসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড তারা করল। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে গেলে এটা চাপিয়ে দিল মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের ঘাড়ে। অথচ আমীরে জামা‘আত এর অনেক আগেই লেখনীর মাধ্যমে, বক্তব্যের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে সরকার ও জনগণকে সর্তক করেছিলেন।
আহলেহাদীছ আন্দোলনকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য এটি ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাত্র। কিন্তু আল্লাহ তাদের পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছেন। আমীরে জামা‘আত ও আমাদের সংগঠন বহাল তবিয়তে রয়েছে। বরং তারাই ধ্বংস হয়ে গেছে। লেবাস-পোশাকে আহলেহাদীছ হয়ে তো কাজ হবে না। যাইহোক আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন এবং জাতিকে সঠিক বিষয়টি বোঝার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
তাওহীদের ডাক : আন্দোলনের অনেক নেতাই বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বাতিলের মোকাবেলা করেছিলেন কিন্তু এক সময় তারাই আবার ইনছাফ পাটির ফাঁদে পা দিলেন কেন? আহলেহদীছ আন্দোলনের এই রাজনীতিকরণ চেষ্টাকে আপনি কিভাবে দেখেছেন?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : এখানে দু’টি কারণ থাকতে পারে, হয়তো তাদের বোঝার ভুল থাকার কারণে অথবা এমন হ’তে পারে তাদেরকে লাগানো হয়েছে একাজের জন্য। আস্তে আস্তে মোড় ঘুরিয়ে তাদেরকে এই রাজনৈতিক পার্টির লোলুপ টোপ দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের উদ্দেশ্য সাধন হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলত। আল্লাহু আ‘লাম। হয়তোবা এ রকম কিছু করার চিন্তা-ভাবনা বা চেষ্টা চলছিল। যারই ফলশ্রুতিতে তারা এই ইনছাফ পার্টির ফাঁদে পা দিলেন। অথচ আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল স্পিরিট ও কর্মসূচী সর্বদা এই গণতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত তাঁর লেখনী ও বক্তব্যে সর্বদাই তা উল্লেখ করে এসেছেন। অথচ এক ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্তের ফাঁদে পড়ে তারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে সঠিকটা বোঝার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
তাওহীদের ডাক : স্বার্থপর দুনিয়ার হাতছানিতে একসময় ঘনিষ্ঠ দ্বীনী ভাইদের আদর্শচ্যুত হ’তে দেখেছেন। এমনকি তাদের অনেকে সংগঠনের গুরুতর বিরোধিতায় নিমজ্জিত রয়েছেন এবং বিভিন্ন সময় সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য হিংসাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য ও নছীহত কি?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : দুনিয়াবী স্বার্থের টানে দ্বীনী ভাইদের কেউ কেউ আদর্শচ্যুত হ’তে পারে এটা স্বাভাবিক। এক সময় আমাকে এক ভাই প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার আমীরে জামা‘আতের কাছে যারা যায়, তারা প্রায়ই খসে পড়ে, টিকতে পারেনা। তখন আমি তাকে এই দু’টি দু’টা উত্তর দিয়েছিলাম। প্রথম বিষয় হ’ল : আমীরে জামা‘আতের সাথে স্বার্থপর লোকেরা টিকে থাকতে পারেনা। কারণ তিনি নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনের কাজ করেন। সেখানে দুনিয়াবী চিন্তা-চেতনা অচল।
দ্বিতীয় বিষয় হ’ল : কিছু লোক আসে মৌসুমী কোকিল হিসাবে। সাময়িকভাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য আসে, ক্যারিয়ার যখন হয়ে যায় তখন সে কেটে পড়ে। এটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগেও ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে উবায়ের নেতৃত্বে ওহোদের যুদ্ধে যাওয়ার পথে তিনশত লোক ভেগে গিয়েছিল। আমি তাকে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম, রাসূল (ছাঃ) এর সাথে যেতে যেতেও খসে পড়েছে। তাহ’লে আমীরে জামা‘আতের সাথে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? তো যাই হোক, এই ক্ষেত্রে আমি নিজেকে আগে নছীহত করছি। যখন কোন জিনিসের ক্রিয়া খুব বেশী শক্তিশালী হয়, তখন তার প্রতিক্রিয়াও শক্তিশালী হয়। একটা ফুটবল যদি আপনি দেয়ালের গায়ে জোরে মারেন, তো রিফ্লেক্স করবে খুব জোরে। যদি হালকার মধ্যে মারেন তো রিফ্লেক্স করবে হালকা। যেসব দ্বীনী ভাইয়েরা স্বার্থের কারণে হোক বা ভুল বুঝাবুঝির কারণেই হোক আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন, তাদেরকে আমাদের বিশেষ নযরে দেখার প্রয়োজন নেই। এতে বরং তাদের বিরোধিতার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। বরং এটাকে আমাদের স্বাভাবিক গতিতে নেয়াই ভাল, রাসূল (ছাঃ)-এর সময়কার কিছু ভেগে যাওয়া লোকদের মত। তবে আমরা তাদের ব্যাপারে ভাল ধারণাই রাখব এবং তাদের ভুল বুঝ থেকে ফিরে আসাই কামনা করব।
এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিলে ভাল হয়। আমি লালমণিরহাট গেলাম, এক ভাইকে প্রশ্ন করলাম। বললাম, ভাই আপনি সংগঠনের কোন পর্যায়ে আছেন? সে বলে, আমি সংগঠন ছেড়ে দিয়েছি। কেন? সংগঠন মানেই ভেজাল, করে কি লাভ? আমি বললাম, আপনি বাজার থেকে যে সয়াবিন তেল কিনে খান সেটা কি ভেজাল না পিওর? আপনি তো বলবেন, ভাই ভেজাল। এক্ষেত্রে তো আপনি বলতে পারেন যে ভেজাল সয়াবিন আমি খাব না। পানি দিয়ে তরকারী রান্না করে খাব। অতএব অজুহাত দিয়ে সংগঠন থেকে নিজের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কেননা শয়তান মানুষের পেছনে লেগে আছে। যে কোন সময় সে আমাদের পথভ্রষ্ট করে দেবে বিচ্ছিন্ন থাকলে। তাছাড়া যেখানে আমি সংগঠনের মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছি, সেখানে যদি আর না যাই, তাহ’লে তো আমার ময়দান অর্ধেক চলে গেল। আমার উস্তায ড. আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলতেন যেখানে সুযোগ পাবে, সেখানেই যাবে। বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি অনেকে আমাদের যুবসংঘ ছেড়ে চলে গেছে। অন্য সংগঠনে গিয়ে ভাল আচরণ পায়নি, আবার ফিরে এসেছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ অনেক আছে।
সর্বোপরি সংগঠন হ’ল একটা উদারতার জায়গা। একটা মানুষ চলতে গেলে যেমন মুচির কাছে যেতে হয়। তেমনি সংগঠন করতে গেলে বিভিন্ন মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। তাই সংগঠনে কাউকে আপনি শতভাগ পাবেন, এটা ভাবা মুশকিল। যাকে যতটুকু পাবেন, কাজ নিন।
তাওহীদের ডাক : যুবসংঘ যখন দাওয়াতী কাজ শুরু করে তখনকার সময়টা কেমন ছিল?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : যুবসংঘ নিঃস্ব অবস্থায় যাত্রা শুরু করেছিল। তখন একটা টাকা দিয়ে সাহায্য করার মত কেউ ছিল না। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সাইকেল চালিয়ে যুবসংঘ করতেন। আমরা নিজেরা ছাত্র থাকাবস্থায় এক টাকা করে চাঁদা তুলেছি। এক সময় পাবনাতে ফটোকপি করার মেশিন ছিল না। ঢাকাতে হাতেগোনা কয়েক জায়গায় হত। ‘যুবসংঘে’র পরিচিতি ক-খ ফুরিয়ে গেছে, তখন আমরা কি করব? তখন আমরা কার্বন কপি করে বিলি করেছি। অনেক জায়গায় আমরা দাওয়াতী কাজে গিয়েছি কিন্তু আমাদের খেতে পর্যন্ত দেয়নি। আমরা পায়ে হেঁটে অনেক কষ্ট করে দাওয়াতী কাজ করেছি। বর্তমানে আল্লাহর মেহেরবানীতে আমাদের অনেক কিছু সহজ হয়ে গেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা দাওয়াতী কাজ করে যাচ্ছি। দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় দাওয়াত পৌঁছে যাচ্ছে। ফালিল্লাহিল হামদ।
তাওহীদের ডাক : একজন দাঈ হিসাবে আপনি ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলন’ সমাজ সংস্কারে কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করেন?
আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী : আমাদের কাজ হচ্ছে সমাজ পরিবর্তন করার, রাষ্ট্র দখল, গদি দখল এগুলো নয়। যে গদি চালাচ্ছে সেই চালাক। একজন মুমিনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজ পরিবর্তন করা। গদি দখলের দায়িত্ব নেওয়া ততটা যরূরী নয়, যতটা যরূরী সমাজ পরিবর্তন করা- ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’ এই মৌলিক সত্যটি ময়দানে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে আলহামদুলিল্লাহ। তাছাড়া ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’ মাঠে ময়দানে আছে বলে আজ মাযহাবীরা আপনার পক্ষে/বিপক্ষে কথা বলছে। কারণ এটা আন্দোলনেরই ফসল।
আমাদের দেশের এক স্বনামধন্য নেতা বলছিলেন, মাদানী সাহেব! মুনাজাত যে বিদ‘আত সেটা আমি জানি। কিন্তু সামনে যে আমি নির্বাচন করব। আর নির্বাচনে মুনাজাতের লোক বেশী। আমি ঘরে বসে আপনাকে সাপোর্ট করি। আর কখনো যদি আপনার লোক বেশী হয় তাহ’লে আমি বাহিরে আপনার কথা বলব। এটুকু তো আন্দোলনের ফল। আর বাকিরা যারা আন্দোলনের বিরোধিতা করছে, এটাও আন্দোলনের ফল। চাইলে আমরা এটাকেও পজিটিভলি নিতে পারি। ফালিল্লাহিল হামদ।
(ক্রমশঃ)