বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় দারাসবাড়ী মাদ্রাসা

আশিক আল-গালিব 565 বার পঠিত

বাংলাদেশে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা রকম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসাবে পরিগণিত। এরকমই একটি আমাদের অনেকেরই কাছে নাম না জানা অপরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দারাসবাড়ি মসজিদ ও বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় দারাসবাড়ি মাদ্রাসা।

এটি বাংলাদেশের প্রাচীন মাদ্রাসারগুলোর একটি। এখন থেকে প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দীন শাহ ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ১লা রামাযানে তদান্তীনকালের বাংলার রাজধানী গৌড়ের ‘ফিরোজপুর’ এলাকায় দারাস বাড়ী মাদ্রাসা নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সুবিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অঞ্চল হতে শিক্ষার্থীরা এখানে সমবেত হতেন এবং গৌড়ের এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে বুখারী ও মুসলিমসহ কুতুবে সিত্তাহ শিক্ষা দেওয়া হতো।

আবিদ আলী খান তাঁর ‘গৌড় ও পান্ডুয়ার স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন দারাসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে কুতুবে সিত্তাহ পড়ানো শুরু হয়। এরপর হুসেন শাহী আমলের পর অর্থাৎ ১৫৩৫ সালের পরে সোনারগাঁয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে কুতুবে সিত্তাহ পড়ানো শুরু হয়। মুহাম্মাদ বিন ইয়াযদান বখশ নামক এক আলেমকে দিয়ে ছহীহ বুখারী নকল করিয়ে ও ফার্সী ভাষায় তা অনুবাদ করিয়ে দারাসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহায়তা নেয় সোনারগাঁয়ের আবু তাওয়ামার[1] বিশ্ববিদ্যালয়। শেখ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহঃ) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে এরই আদলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন এবং যেখানে কুতুবে সিত্তাহর ‘কালাল্লাহ ও কালার রাসূল’ গুঞ্জণ পুরো জাতিকে শিহরিত করেছিল। যার ফলে এ শতাব্দীতে এসেও স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও তার আবেদন রয়ে গেছে। দারাসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীছ শাস্ত্র, গণিত, তাফসীর, চিকিৎসা, রসায়ন, সাহিত্য এবং সমসাময়িক সকল বিষয়ে পড়ানো হতো বলে জানা যায়। ১৯৭৩ সালে স্থানীয় লোকজন চাষাবাদের সময়ে স্থানীয়দের দ্বারা কালো পাথরের একটি শিলাঢিবি আবিষ্কৃত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করা হয়। এরপর উদ্ধার হয় মাটি নীচে চাপা পড়ে থাকা প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ‘অাঁতুড়ঘর’ নামে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়।

দারস (درس) অর্থ পাঠ। দারস+বাড়ি অর্থ যে বাড়িতে পাঠদান করা হয় অর্থাৎ পাঠশালা। দারস ও বাড়ি আরবী ও বাংলা শব্দ দু’টি কালের আবর্তে কিঞ্চিত অপভ্রংশ হয়ে একক শব্দ দারাসবাড়িতে রুপান্তরিত হয়েছে। দারাসবাড়ি মাদ্রাসা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মানের পাঠদান কেন্দ্র ছিল। এ স্থাপনায় বর্গাকৃতির ছড়াছড়ি। বর্গাকার এ স্থাপনাটির প্রতিটি বাহু প্রায় ১৬৯ ফুট দীর্ঘ। ছাত্রদের ঘরগুলোও বর্গাকৃতির। পুরো স্থাপানার ঠিক মাঝখানে অধ্যক্ষ ছাহেবের অফিস ঘরটিও বর্গাকৃতির। পশ্চিম দিকে কোন প্রবেশ পথ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্গাকার চত্বরের পশ্চিম বাহু ব্যতীত অন্য বাহুতে এক সারি করে প্রকোষ্ঠ এবং তিন বাহুর মধ্যবর্তী একটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। পশ্চিম বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে পাশাপাশি তিনটি ছালাতের ঘর রয়েছে। ছালাতের ঘরের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। শোভাবর্ধক পোড়া মাটির ফলক ও নকশা করা ইট দিয়ে দেয়ালগুলো অলঙ্কৃত আছে। টিকে থাকা গড়ে প্রায় ৪ ফুট উঁচু দেওয়ালের উপরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১ ইট পরিমাণ গাঁথুনি দিয়ে দেওয়ালটি টেকসই করার পদক্ষেপ নিয়েছে। দারাসবাড়ি দিঘীর এক পাড়ে মসজিদ এবং অন্য পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এই মসজিদটি আকারে ছোট সোনা মসজিদের চেয়েও বড়। এখানে মোট কক্ষের সংখ্যা ৩৭টি। অধ্যক্ষের অফিস রুম মধ্যখানে ১টি। মাদ্রাসার মোট ৩টি দরজা রয়েছে, যা এর অবশিষ্টাংশে এখনো স্পষ্ট।

দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসার অবস্থান ছোট সোনা মসজিদ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। এর অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেলার ছোট সোনা মসজিদের সন্নিকটে। সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে মহানন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সীমান্ত তল্লাশী ঘাঁটি। এই ঘাটির অদূরে অবস্থিত দখল দরওয়াজা। দখল দরওয়াজা থেকে প্রায় এক কি.মি. হেঁটে আমবাগানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে একটি দিঘী পার হয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে ঘোষপুর মৌজায় দারাসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান।

দীর্ঘদিন মাটিচাপা পড়ে ছিল এ মসজিদ। সত্তর দশকের প্রথমভাগে খনন করে এটিকে উদ্ধার করা হয়। মসজিদটি দীর্ঘকাল আগে পরিত্যাক্ত হয়েছে, বর্তমানে এর চারপাশে আছে গাছগাছালির ঘেরা। পরিচর্যার অভাবে এ মসজিদটি বিলীয়মান। ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে (হিজরী ৮৮৪) সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তাঁরই আদেশক্রমে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মানে এটি ছোট সোনা মসজিদের আগেই তৈরী হওয়া।  শুরুতে এই মসজিদের নাম দারাসবাড়ী ছিল না। ফিরোজপুর নামে মসজিদ ছিল। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে যখন সুলতান হোসেন শাহ্ কর্তৃক দারাসবাড়ী বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয়, তখন অত্র অঞ্চলের নাম দারাসবাড়ী নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। ফিরোজপুর জামে মসজিদ নাম হারিয়ে দারাসবাড়ী নাম ধারণ করে। উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ রয়েছে উত্তর দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। এতদ্ব্যতীত পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি করে ৯টি কারুকার্য খচিত মেহরাব বর্তমান রয়েছে। এই মসজিদের চারপার্শ্বে দেয়াল ও কয়েকটি প্রস্তর স্তম্ভের মূলদেশ ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই মসজিদের বিশেষত্ব হ’ল এতে মহিলাদের ছালাত পড়ার ব্যবস্থা ছিলো। উত্তর পশ্চিম কোণে মহিলাদের ছালাতের জন্য পাথরের স্তম্ভ এবং তার উপরে আলাদা একটি ছাদ ছিল। প্রাচীন মসজিদ নিয়ে কাজ করার পর থেকে এই প্রথম মহিলাদের জন্য ব্যবস্থাসমৃদ্ধ একটি মসজিদ পেলাম।

দারাসবাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়টি ও মসজিদ কীভাবে হারিয়ে যায় ও মাটির নিচে চাপা পড়ে এই ব্যাপারে সঠিক বক্তব্য পাওয়া যায় না।  প্লেগ রোগের আবির্ভাবের পর গৌড় থেকে মানুষ পালিয়ে যায়। এরপর কোন এক সময় হয়তো ভূমিকম্পে মাটি চাপা পড়ে অনিন্দ্য এই স্থাপনাগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসাটি বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেলার শিবগঞ্জ উপযেলার শাহবাজপুরে অবস্থিত।


[1]. মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃতঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০ খৃঃ) বুখারা হ’তে ইলমে হাদীছের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রথমে দিল্লী আসেন। অল্পদিনে তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় আলেমগণ সক্রিয় হয়ে ওঠেন ও অবশেষে মামলূক সুলতান গিয়াছুদ্দীন বলবনের (৬৬৪-৬৮৭ হিঃ/১২৬৬-১২৮৭ খৃঃ) নির্দেশে তাঁকে দিল্লী ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তিনি বিহার হয়ে বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ে ৬৬৭হিঃ/১২৬৯ খৃষ্টাব্দে উপনীত হন। আবু তাওয়ামাই সর্বপ্রথম হিন্দুস্থানের মাটিতে ‘ছহীহায়েন’ নিয়ে আসেন এবং সোনারগাঁয়ে তার দারস শুরু করেন। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই গৌরবধন্য  দেশ। আমৃত্যু তিনি এখানে ইলমে হাদীছের দরস দেন। অসংখ্য দেশী-বিদেশী ছাত্রের এখানে আগমন ঘটে। আধুনিক পরিভাষায় যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছহীহ বুখারীর একটি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন। সপ্তম শতাব্দী হিজরী শেষে মুহাদ্দিছ আবু তাওয়ামার মৃত্যুর পর তাঁর শিক্ষার আলোকবর্তিকা পরবর্তী আড়াইশত বৎসর যাবত বাংলার যমীনে নিভু নিভু ভাবে হ’লেও আহলেহাদীছ আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখে। দশম শতাব্দী হিজরীর প্রথম দিকে বার ভূঁইয়াদের সময়ে (৯০০-৯৪৫ হিঃ/১৪৯২-১৫৩৮ খৃঃ) তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসাবে সোনারগাঁও একটি সমৃদ্ধিশালী নগরী হওয়ার সাথে সাথে ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবেও খ্যাত ছিল। ঐ সময় মুহাদ্দিছগণের কদর ছিল। এতদ্ব্যতীত বাংলার স্বাধীন হুসেন শাহী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ বিন আশরাফ মাক্কী (৯০০-৯৪৫/১৪৯২-১৫১৮ খৃঃ) ইলমে হাদীছের প্রসারে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। রাজধানী একডালাতে মুহাম্মাদ বিন ইয়াযদান বখ্শ ওরফে ‘খাজেগী শিরওয়ানী’র ন্যায় মুহাদ্দিছগণের অবস্থান ও ছহীহ বুখারী শরীফের লিপির লিপিকরণ-এর স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। সুলতান মালদহের ‘পান্ডুয়া’তে নূর কুতবে আলমের (৭৫০-৮৫০/১৩৪৯-১৪৪৬ খৃঃ) স্মরণে একটি এবং ‘গোরাশহীদ’ এলাকায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। যেখানে প্রচলিত ফিকহী ও মা‘কূলাতভিত্তিক সিলেবাসের বিপরীতে ইলমে হাদীছকে আবশ্যিক সিলেবাসে পরিণত করেন। এজন্য তাঁকে সমসাময়িক গুজরাটের মুযাফ্ফরশাহী সুলতানদের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামার কোন বাংগালী ছাত্রের নাম জানা না  গেলেও বাংলাদেশ অঞ্চল  যে ইলমে হাদীছের প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, একথা বলা চলে (দ্র. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’, পৃ. ২৩৩-২৪০)।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও