যালেমদের মর্মান্তিক পরিণতি
ইহসান ইলাহী যহীর
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 736 বার পঠিত
(২২) রামরাজ্য : অযোধ্যাপতি রামচন্দ্রের রাজত্বকালে প্রজাগণ পরম সুখে বসবাস করত। বলা হয়ে থাকে রামের প্রজাপালন গুণে রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, অকালমৃত্যু, রোগ, শোক, অন্যায়-অবিচার কিছুই ছিল না। এজন্য যেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে তাকে ‘রামরাজ্য’ অর্থাৎ সুখের জীবন হিসাবে অভিহিত করা হয়’।[1] রাম কিংবা রাবণের অস্তিত্ব কেবল হিন্দু শাস্ত্রে বিদ্যমান। রামরাজ্য প্রবাদ আমাদের ব্যবহারিক জীবনে স্থান পাওয়ায় নিজেদের অজান্তেই আমরা রাম ও তার রাজ্যের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিচ্ছি। সুতরাং সাহিত্যে ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব এড়াতে সাহিত্যিকদের উক্ত প্রবাদের ব্যবহার পরিত্যাগ করতে হবে।
(২৩) শাপে বর : শাপ অর্থ অভিশাপ এবং বর অর্থ দেবতা কিংবা মুনি-ঋষিদের মুখ নিঃসৃত কল্যাণ বাক্য। শাপে বর প্রবাদটির অর্থ অনিষ্টে ইষ্ট লাভ অথবা অকল্যাণ থেকে কল্যাণ লাভ করা। অযোধ্যার রাজা দশরথের তিন স্ত্রী থাকার পরও দীর্ঘদিন সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। একদিন তিনি হরিণ শিকারে বনে যান। আবছা অন্ধকারে শব্দ ভেদী বান[2] নিক্ষেপ করে ভুলক্রমে অন্ধ ঋষির একমাত্র পুত্রকে হত্যা করেন। ঋষি দম্পতি অন্ধ ছিলেন বিধায় তাদের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব সে পুত্রের উপর ন্যস্ত ছিল। পুত্র শোকে বিহবল হয়ে ঋষি রাজা দশরথকে পুত্র শোকে মৃত্যু হওয়ার অভিশাপ দেন। উক্ত অভিশাপ কেবল পুত্র সন্তান থাকলেই বাস্তবায়ন সম্ভব। অথচ দশরথের তখনো কোন পুত্রই ছিল না। সেজন্য এই অভিশাপ প্রকারান্তরে তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। নিঃসন্তান রাজা পুত্র লাভ করেন। তাই কারো অপকারের জন্য অভিশাপ দেওয়ার পর সেটা যদি উপকারে পরিণত হয় তখন সে অবস্থাকে শাপে বর বলা হয়’।[3]
(২৪) রাবণের চিতা : চির অশান্তি অর্থে রাবণের চিতা প্রবাদটির উপমা দেওয়া হয়। রাবণ রামের হাতে নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রী ও প্রজাগণ শোক পালন করতে থাকে। বলা হয় রাবণ রাক্ষস হলেও অত্যন্ত প্রজা বাৎসল, ন্যায়পরায়ণ, শিবভক্ত ও বেদের পন্ডিত ছিল। তার মৃত্যুতে লঙ্কা একজন মহৎ রাজা হারায়। অন্য দিকে তার স্ত্রী মন্দোদরীর সাথে রাবণের ভাই বিভীষণের বিবাহ হলেও প্রিয়জন হারানোর বেদনা মন্দোদরীর মনে রয়েই যায়। আবার কথিত আছে রাবণের চিতা নাকি কখনো নিভবে না। সে দৃষ্টিকোণ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ দুঃখ-কষ্টে কিংবা অশান্তি ভোগ করাকে উপমায়িত করতে উক্ত প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।
(২৫) কংস মামা : প্রবাদে শকুনি মামা ও কংস মামা একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কংস বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রী কৃষ্ণের মামা। সে শক্তিশালী দানব ছিল। নিজ পিতাকে পরাজিত করে কংস মথুরায় সিংহাসন হরণ করে। কংসের বোন দেবকীর সাথে যাদব বংশীয় রাজা বসুদেবের বিবাহ হয়। বিবাহের দিন গায়েবী এক আওয়াজে বলা হয় দেবকীর অষ্টম সন্তান কংসকে হত্যা করবে। গায়েবী আওয়াজ শোনার পর সে দেবকী ও বসুদেবকে বন্দি করে রাখে। অতঃপর তাদের ৬ জন পুত্রকে জন্মের পরপরই হত্যা করে। সপ্তম সন্তান গর্ভেই নষ্ট হয়ে যায়। অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করলে বসুদেব কারাগার থেকে কৌশলে বের হয়ে তাকে মথুরার একটি গ্রাম গোকুলে নন্দ ঘোষের বাড়িতে রেখে আসে’।[4] কংস নিজ বোনের নবজাত সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার দরুন সনাতন ইতিহাসে পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হিসাবে পরিচিত। এজন্য কংস মামা বলতে ‘নির্মম আত্মীয়’ বোঝানো হয়।
(২৬) গোকুলের ষাঁড় : কৃষ্ণের বাল্য ভূমি মথুরার গোকুল গ্রামের বাসিন্দারা সকলেই ঘোষ ছিল। গরু-ছাগল পালন তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল। গরুগুলো গোকুলের চারণভূমিতে ইচ্ছা স্বাধীন ঘুরে বেড়াত। যেহেতু গরুকে দেবতা জ্ঞান করা হয় সেজন্য গরুগুলো কারো অনিষ্ট করলেও ধর্ম ভঙ্গের ভয়ে কেউ কিছু বলতো না। সেখান থেকেই সমাজে কেউ বল্গাহীনভাবে চলাচল করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করলেও যখন, তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না; সে অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করতে ‘গোকুলের ষাঁড়’ প্রবাদ অর্থাৎ চরম স্বেচ্ছাচারী বলা হয়।
(২৭) সাক্ষী গোপাল : কথিত আছে একদা এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তীর্থ যাত্রাকালে পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সহযাত্রীদের মধ্য থেকে তার গ্রামের এক যুবক তাকে সেবা-শুশ্রুষা করে। এতে বৃদ্ধ আরোগ্য লাভ করে সে যুবককে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, বাড়ি ফিরে সে তার কন্যার সাথে সে যুবকের বিবাহ দিবে। কিন্তু যুবক মেŠখিক কথায় বিশ্বাস করতে না পারায় স্থানীয় কৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে কৃষ্ণের মূর্তির সামনে সে বৃদ্ধকে শপথ করায়। পরবর্তীতে তীর্থ সমাপ্ত হওয়ার পর উভয়ে গ্রামে ফিরে যায়। যুবক বৃদ্ধকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করায় দেয় কিন্তু বৃদ্ধ তা অস্বীকার করে। তখন যুবক সেই কৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করে বলে, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আপনার সামনে তার মেয়েকে আমার সাথে বিবাহ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও অস্বীকার করেছে। এখন আপনাকে তার বাড়িতে গিয়ে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে হবে। কৃষ্ণ মূর্তি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে বলে, তুমি যাও, আমি তোমার পিছন পিছন আসছি। কিন্তু তুমি পেছনে ফিরে তাকাবে না, তাহ’লে আমি আর যাব না। আমার নূপুরধ্বনি শুনলে বুঝবে আমি যাচ্ছি। কিছুদূর যাওয়ার পর নূপুরধ্বনি শুনতে না পেয়ে যুবক পেছনে ফিরে তাকায়। ফলে কৃষ্ণ সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। যুবক বলে, আপনার নূপুরধ্বনি শুনতে না পাওয়ায় পেছনে তাকিয়েছি। মূর্তি বলে, বালুকাময় পথে হাঁটার কারণে নূপুরে বালু ঢুকে যায়। এ কারণে নূপুরধ্বনি শোনা যায় নি। যাই হোক, এ ঘটনা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কাছে বর্ণনা করলে সে বাধ্য হয়ে যুবকের সাথে স্বীয় কন্যার বিবাহ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, কৃষ্ণের অপর নাম গোপাল। কালক্রমে এ ঘটনার আলোকে নিষ্ক্রীয় দর্শক বা যার কোন ভূমিকা নেই অর্থে ‘সাক্ষী গোপাল’ প্রবাদ রূপ লাভ করে’।[5]
(২৮) অতি দানে বলির পাতালে হল ঠাঁই : দৈত্য রাজা বিরোচন পুত্র বলি ভোগ বিলাসে লিপ্ত দেবতাদের পরাজিত করে পৃথিবী ও স্বর্গে আধিপত্য বিস্তার করে। স্বীয় রাজত্ব স্থায়ীকরণের উদ্দেশ্যে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞ নামক এক বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বলি দৈত্য হলেও অত্যন্ত দানশীল ও ন্যায়পরায়ণ ছিল বলে বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যজ্ঞের নিয়মানুযায়ী যজ্ঞ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বে ব্রাহ্মণদের দান করতে হবে। বলি দু’হাতে দান করতে থাকে। এই যজ্ঞের পরিণতি দেবতাদের জন্য ভয়ানক হবে চিন্তা করে দেবতা বিষ্ণু বামন ব্রাহ্মণরূপ ধারণ করে বলির কাছে দান চাইতে আসে। দান হিসাবে সে তিন ধাপ পরিমাণ ভূমি চায়। দৈত্যগুরু বামন বালক ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলিকে দান করতে নিষেধ করেন কিন্তু বলি তা উপেক্ষা করে। দৈত্যরাজ তাকে সে পরিমাণ ভূমি দান করতে সম্মত হয়। কিন্তু বিষ্ণু কৌশলে এক ধাপে পৃথিবী, এক ধাপে অন্তরীক্ষ অধিকার করেন। প্রতিশ্রুতির কথা ভেবে তৃতীয় ধাপ বলি তার মাথায় রাখতে বললে বিষ্ণু বলিকে নিজ ক্ষমতায় পাতালে স্থানান্তরিত করে’।[6] দান করতে গিয়ে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করার কারণে বলিকে অবশেষে পাতালে যেতে হয়। এই ঘটনার আলোকে কোন কিছুর বাড়াবাড়ি ভাল নয় বোঝানোর তাৎপর্যে উক্ত প্রবাদটির জন্ম হয়।
(২৯) অগস্ত্য যাত্রা : হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী সূর্য প্রতিদিন উদয় হওয়ার পর সুমেরু নামক কোন এক পর্বতকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে এবং দিন শেষে অস্ত যায়। একদিন বিন্ধ্যা পর্বত সূর্য দেবতাকে অনুরোধ করে যেন তাকে প্রদক্ষিণ করা হয়। কিন্তু সূর্য দেবতা অস্বীকৃতি জানায়। এতে বিন্ধ্যা পর্বত নিজের আকৃতি বাড়িয়ে সূর্যকে ঢেকে দেয়। ফলে সারা পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। দেবতারা বিন্ধ্যাকে আকার ছোট করার জন্য অনুরোধ করলেও কোন লাভ হয় না। পৃথিবীবাসী সংকটে পড়ে বিন্ধ্যা পর্বতের পূজা শুরু করে। তাতেও বিন্ধ্যা আকার সংকুচিত করল না। অবশেষে হতাশ হয়ে সকলে বিন্ধ্যের শিক্ষাগুরু ঋষি অগস্ত্যের শরণাপন্ন হয়ে সমাধান প্রার্থনা করে। অগস্ত্য মুনি বিন্ধ্যার নিকট গেলে সম্মানার্থে পর্বত মাথা নুইয়ে অগস্ত্যকে প্রণাম করে। ঋষি অগস্ত্য সে সুযোগে বিন্ধ্যাকে বললেন, আমি দক্ষিণ দিক থেকে না ফেরা পর্যন্ত তুমি এভাবেই মাথা নুইয়ে থাকবে। এই কথা বলেই ঋষি দক্ষিণ দিকে গেলেন কিন্তু আর ফিরে আসলেন না। অগস্ত্য ঋষির এই যাত্রাকেই অগস্ত্য যাত্রা বলা হয়’।[7] যা পরবর্তীকালে চির বিদায় ভাবার্থে প্রবাদ হিসাবে চালু হয়। জনশ্রুতি আছে অগস্ত্য মুনি ১লা ভাদ্র দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেছিলেন বিধায় সে মাসের ১লা তারিখে সফর করা দোষণীয়! এ দোষকে আবার অগস্ত্য দোষ বলা হয় (?)।[8]
(৩০) অতি মন্থনে বিষ ওঠে : প্রবাদটির অর্থ একটি বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত আলোড়ন ক্ষতিকারক। এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য হিনদু পুরাণের একটি কাহিনী জানা আবশ্যক। মহাভারতের বর্ণনা মতে, দেবতা ও অসুর একত্রিত হয়ে অমৃত পাওয়ার আশায় সমুদ্র মন্থন বা আলোড়ন করে। কোন এক ক্ষীর সাগরে মন্দর নামক পবর্তকে মন্থন দন্ড এবং সর্পরাজা বাসুকীকে রশি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পর্বতকে সাগরে নিক্ষেপ করে বাসুকীকে পর্বতের সাথে পেঁচিয়ে এক পার্শ্বে দেবতা ও অন্য পার্শ্বে অসুররা ধরে আলোড়িত করতে থাকে। এতে সমুদ্র থেকে বহু মূল্য ধন-রত্ন ও অমৃত উঠে আসে’।[9] কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় দেবতারা ধন-রত্ন পাওয়ার আশায় লোভাতুর হয়ে মন্থন চালিয়ে যেতে থাকলে সমুদ্র থেকে বিষ ওঠে আসে। মূলত ও ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ‘অতি মন্থনে বিষ উঠেও’ প্রবাদটির জন্ম। মহাভারতে সে বিষকে কালকূট বলা হয়েছে। এই বিষ পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়লে ব্রহ্মার অনুরোধে দেবতা শিব সে বিষ খেয়ে নীল কণ্ঠ উপাধি লাভ করেন’।[10] ঘটনার এ অংশ থেকে ‘বিষ খেয়ে বিশ্বম্ভর’ শিরোনামে আরো একটি প্রবাদ পাওয়া যায়। যার শাব্দিক অর্থ বিষ খেয়ে যিনি বিশ্বকে ধারণ করেছেন বা রক্ষা করেছেন। প্রবাদটির রূপক অর্থ সংসারের জ্বালায় বিরক্ত কিংবা বিপদের রক্ষাকর্তা। মূলত এখানে শিবের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে।
(৩১) ভুষন্ডির কাক : ভুষন্ডি হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত ত্রিযুগ দর্শী কাক, দীর্ঘজীবী, বহুদর্শী। যে বহু বছর এবং মৃত্যুর বয়স হওয়া সত্ত্বেও জীবিত আছে; অপ্রত্যাশিতভাবে দীর্ঘজীবী’।[11] সুমেরু পর্বতের এক বৃক্ষে এ কাকের বসবাস। এই পাখির বর্ণনায় বলা হয়েছে সে চিরঞ্জীব, সুচতুর, মুগ্ধভাষী, বিরাটাকায় এবং দেখতে গাঢ় শ্যামবর্ণ। কোন এক সময় স্বর্গে চন্ড নামক এক কাকের সাথে শিবের অনুচর দেবীগণের বাহন হাঁসের মিলন হয়। এতে হাঁসেরা বিষ্ণুর নাভি থেকে উৎসারিত পদ্মফুলের পাঁপড়িতে ২১টি ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে ২১টি কাকের জন্ম হয়। ভুষন্ডি সেই কাকের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবী কাক’।[12] ধারণা করা হয় এই কাকটি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবহিত। যার মরণ নাই এবং যুগের আবর্তন অনাদিকাল থেকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে আসছে। এজন্য উক্ত গল্পের ভিত্তিতে জ্ঞানী, বহু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দীর্ঘ হায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ‘ভুষন্ডির কাক’ নামে অভিহিত করা হয়।
(৩২) দক্ষ যজ্ঞ ব্যাপার : এই প্রবাদটির দু’টি অর্থ রয়েছে। প্রথমতঃ বিদ্রুপার্থে সামান্য ব্যাপারে বিরাট আয়োজন বোঝায়। দ্বিতীয়ত কোন মহৎ উদ্দেশ্যে বড় কাজ পন্ড হলে তাকেও দক্ষ যজ্ঞ ব্যাপার বলা হয়’।[13] উল্লেখ্য যে, যজ্ঞ হিন্দু বৈদিক শাস্ত্রীয় এক প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হিন্দুগণ আগুনকে সর্বাধিক পবিত্র মনে করেন। সেজন্য আগুনে ঘি ঢেলে মন্ত্র পাঠে যে অনুষ্ঠান পালন করা হয় তাই যজ্ঞ। দক্ষ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পুত্র। ব্রহ্মা তাকে আইন প্রণেতা ও প্রজাপতি তথা রাজা নিযুক্ত করেন। তার সীতা নামে এক কন্যার সাথে শিবের বিবাহ হয়েছিল। দক্ষ শিবকে দেবতা হিসাবে মান্য করত না। একদিন দক্ষ বিরাট এক যজ্ঞের আয়োজন করে। তাতে সকল দেবতাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও অপমান করার জন্য শিবকে আমন্ত্রণ করেনি। যজ্ঞের দিন সীতা দক্ষের বাড়িতে আসতে চাইলে শিব অনুমতি দেয় না। তথাপি সে শিবকে বুঝিয়ে দক্ষের বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখন দক্ষ সীতার উপস্থিতিতে শিবকে কটু বাক্যে অপমান করে। স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সীতা যজ্ঞের আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনা শিব প্রত্যক্ষ করে যজ্ঞ পন্ড করার জন্য বীর ভদ্র ও ভদ্র কালীকে দক্ষের বাড়িতে পাঠায়। তারা সমস্ত দেবতা ও দক্ষের সেনার সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয় ও যজ্ঞ পন্ড করে দেয়। পরিশেষে বীরভদ্র দক্ষের শিরচ্ছেদ করে’।[14] এই ঘটনার ভিত্তিতেই ‘দক্ষ যজ্ঞ ব্যাপার’ বাক্যটি বাংলার পাঠ্য বইয়ে বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ। আমরা কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই বড় আয়োজনকে কর্ম যজ্ঞ বলে থাকি। মূলত দক্ষের যজ্ঞ অনুষ্ঠানের ভাবার্থকে কেন্দ্র করেই কর্ম যজ্ঞ শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যজ্ঞ যেহেতু ভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সেহেতু এই শব্দ ব্যবহার না করা মুসলিমদের ঈমানী কর্তব্য।
(৩৩) ধোয়া তুলসি পাতা : তুলসি একটি ঔষধী গুণ বিশিষ্ট সুগন্ধীযুক্ত উদ্ভিদজাত বৃক্ষ। সর্দি-কাশি জনিত সমস্যায় এই গাছের পাতার রস কার্যকরী ঔষধের ভূমিকা পালন করে। ধোয়া তুলসি পাতা বলতে পবিত্র বা নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী বোঝানো হয়। তবে আমরা প্রবচনটি কাউকে কটাক্ষ করতে বেশী ব্যবহার করে থাকি। তুলসি গাছ ও এর পাতাকে হিন্দু ধর্মালম্ব^ীগণ পবিত্র মনে করে পূঁজা করে থাকে। তুলসি গাছকে পবিত্র ধারণা করার পিছনে হিন্দু বিভিন্ন পুরাণে দীর্ঘ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তুলসি নামে এক কন্যা পরম কৃষ্ণ ভক্ত ছিল। সে কৃষ্ণ তথা বিষ্ণুকে স্বামী হিসাবে পেতে চাইত। তুলসি বিষ্ণুর কৃষ্ণ অবতারে রাধিকার সহচর ছিল। অপরদিকে তুলসি প্রেমিক সুদামাও কৃষ্ণ ভক্ত ছিল। একদিন তুলসিকে কৃষ্ণের সাথে ক্রীড়ারত দেখে রাধিকা সুদামা তুলসিকে অভিশাপ দেয়। ফলে রাজা ধর্মধ্বজের কন্যারূপে তুলসির এবং অসুর বংশে শঙ্খচূড় নামে সুদামার পুনর্জন্ম হয়। যৌবনে তুলসি বিষ্ণুর পত্নী হওয়ার জন্য ব্রহ্মার তপস্যা করে। ব্রহ্মা তুলসিকে শঙ্খচূড়ের স্ত্রী হওয়ার বর প্রদান করেন। তুলসি ও শঙ্খচূড়ের বিবাহ হয়।
শঙ্খচূড় কঠোর তপস্যা করে দু’টি বর লাভ করে। একটি কৃষ্ণ কবজ অপরটি তার স্ত্রীর সতীত্ব। সে শর্ত দেয় যে, তার স্ত্রীর সতীত্ব থাকা অবস্থায় কেউ যেন তাকে হত্যা করতে না পারে। বর লাভের পর শঙ্খচূড় পরোক্ষভাবে অমরত্ব পায়। ফলে দেবতাদের পরাজিত করে ইন্দ্রলোক দখল করে। দেবতারা শিবের সাহায্য প্রার্থনা করলে শিব ও শঙ্খচূড়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শিব অসুর শঙ্খচূড়কে পরাস্ত করতে পারে না। অতঃপর বিষ্ণু ছলনা করে শঙ্খচূড়ের কাছ থেকে কবজ নিয়ে নেয়। অপরদিকে শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করে তুলসির সতীত্ব হরণ করে। ফলশ্রুতিতে শঙ্খচূড়ের মৃত্যু ঘটে। শঙ্খচূড়ের অস্থি লবণ সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। ধারণা করা হয় সেখান থেকেই শঙ্খ বা শাখের জন্ম হয়। এজন্য হিন্দুদের নিকট শাখের পানি পবিত্র। শাখের পানি দিয়ে গোছল করলে তীর্থসণান করার ফল লাভ হবে বলে পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে শঙ্খচূড়ের হত্যার বিষয়টি তুলসি বুঝতে পেরে বিষ্ণুকে পাষাণ হওয়ার অভিশাপ দেয়। কেননা তুলসি শুধুমাত্র তাকে বিবাহ করার জন্য দু’বার জন্মগ্রহণ করে। অথচ সে তুলসিকে বিবাহের পরিবর্তে তার সত্বীত হরণ করে। পরিশেষে বিষ্ণু তুলসিকে বর দেয় যে, তার দেহ থেকে গন্ডকী নদী প্রবাহীত হবে এবং সেখানে পাষাণরূপে শালগ্রাম পাথর বেশে বিষ্ণুর বসবাস হবে’।[15]
সেই সাথে তুলসির চুল থেকে তুলসি বৃক্ষের জন্ম হবে যেখানে পাষাণ খন্ড তথা পাথর খন্ডের সাথে তুলসির বিবাহ হবে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, বিষ্ণুর সামনে একদিন স্বরসতী ও তুলসি ঝগড়া করে। এতে তুলসি অপমাণিত হয়ে ভূ-গহবরে অন্তর্হিত হয়। অতঃপর বিষ্ণু দশ অক্ষরে মন্ত্র পাঠ করে তুলসিকে আহবান করলে, তুলসি বৃক্ষরূপে বের হয়ে আসে। বিষ্ণু ঘোষণা করে ঘি-এর প্রদীপ, সিঁদূর, চন্দন, ধূপ ও ফুল দিয়ে যে ব্যক্তি তুলসি বৃক্ষের পূজা করবে সে সিদ্ধি লাভ করবে’।[16]
ঠিক এ কারণেই হিন্দুদের নিকট তুলসি গাছ পূজনীয় এবং সর্বাধিক পবিত্র। এ ঘটনা অবলম্বনে তুলসিকে পবিত্র বৃক্ষ মনে করে ‘ধোয়া তুলসি পাতা’ প্রবচনটির উৎপত্তি ঘটেছে। এভাবে মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দুয়ানী প্রবাদ-প্রবচন প্রবেশ করেছে। কখন এসব প্রবাদ-প্রবচন ঈমান ও আক্বীদা বিনষ্ট করে দেয়। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের এত্থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
(ক্রমশঃ)
[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]
[1]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ.১৬০৯।
[2]. শব্দ শুনে অনুমানের ভিত্তিতে বান নিক্ষেপ করা।
[3]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ : ১৬১৫।
[4]. শ্রীমদ্ভাগবত, বঙ্গানুবাদ সম্পাদনা : শ্রীযুক্ত তারাকান্ত কাব্যতীর্থ ভট্টাচার্য, পি.এম. বাক্চি এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, গোহাটী, ৯ম সংস্করণ, বাংলা ১৩৮৩ সন, দশম স্কন্ধ, কৃষ্ণের জন্ম অংশ দ্রষ্টব্য, পৃ. ৫৯৩।
[5]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ.১৬২০।
[6]. রামায়ণ, রাজশেখর বসু, ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮ সন, পৃ. ২৫।
[7]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ. ১৫১৭-১৮।
[8]. বাংলার লোক সাহিত্য, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, ১ম সংস্করণ : বাংলা ১৩৭১ সন, এ. মুখার্জী অ্যান্ড কোং লি. ২ কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা-১, ৬ষ্ঠ খন্ড, প্রবাদ অংশ, পৃ. ২।
[9]. অমৃত এমন পানীয় যা ব্যক্তিকে অমরত্ব দান করে।
[10]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, এম. সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা- ৭০০০৭৩, ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮ সন, আদিপর্ব, পৃ. ১৫।
[11]. সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমী, পুনর্মমদ্রণ মে ২০১৫, পৃ. ৪৩৯।
[12]. যোগবাশিষ্ট রামায়ণ, নির্বাণ অধ্যায়, অনুবাদ : চন্দ্রনাথ বসু, এল. এন. প্রেস-২৪, রাজানবকৃষ্ণের স্ট্রীট, বাংলা ১৩১৮ সাল, পৃ. ৮২-৯৫
[13]. সরল বাঙ্গলা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ.১৫৫৫-৫৬।
[14]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, এম. সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা- ৭০০০৭৩, ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮ সন, পৃ. ৫৮৫-৮৬।
[15]. বলা হয় শালগ্রাম কৃষ্ণবর্ণ গোলাকার পাথর খন্ড। এ পাথরকে নারায়ণ তথা বিষ্ণুর প্রতীকীরূপ ধরা হয়।
তুলসি বৃক্ষের পাদদেশে এ পাথর রেখে হিন্দুরা পূঁজা করে। বাংলার প্রবাদ, ড. সুশীলকুমার দে, পত্র ভারতী প্রকাশনী, ১ম সংস্করণ, আগষ্ট ২০০০, পৃ. ৩৬।
[16]. ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, অনুবাদ : শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেব সাহিত্য কুটীর, ২২৫ বি, ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ ১৩৬০ বঙ্গাব্দ, প্রকৃতি খন্ড, ১৩তম অধ্যায়, পৃ. ১১২-১৪১।