সন্তানদের প্রতি উম্মে হাকীমাহর উপদেশমালা
মুখতারুল ইসলাম
মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 2877 বার পঠিত
ভূমিকা:
মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে সমাজবদ্ধভাবেই তাকে থাকতে হয়। সমাজের কারোর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা থাকলে সমাজের অপরাপর মানুষের অশান্তি ও দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। এ কারণে সকল যুগে সকল সমাজে অপরাধপ্রবণ লোকদের হাত থেকে সমাজের শান্তিপ্রিয় অপরাপর জনগণের জানমাল রক্ষার জন্যে যেমন দন্ডবিধি চালু হয়েছে, তেমনি অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিকার অপরাধী কি না, তা নির্ণয় করার জন্যেও বিচার বিভাগ এবং বিচারের রায় কার্যকর করার জন্য রয়েছে শাসন বিভাগ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপরাধ আইনে কমবেশি কিছুটা পার্থক্য থাকলেও লক্ষ্য সকলেরই অভিন্ন অর্থাৎ অপরাধ দমন ও তা নির্মূল করা। কিন্তু প্রায় দেশেই এ লক্ষ্য আশানুরূপভাবে অর্জিত হয়নি। ফলে দন্ডবিধি পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞ অপরাধদমন বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদের মতে, অপরাধপ্রবণতা দূরীকরণে শাস্তির কঠোরতা নয়, বরং অপরাধীকে মানুষের সামনে অপরাধী হিসাবে উপস্থাপন যরূরী। যেমন অপরাধীর সামাজিক সম্ভ্রমে আঘাত হানা। কারণ একজন অপরাধীকে লোকদৃষ্টির অগোচরে যত কঠোর শাস্তিই দেয়া হোক, বাইরে সেটার খবর প্রকাশে অপরাধী সাময়িকভাবে নিজেকে যতটা না অপমানিত বোধ করে, তার চাইতে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে তার শাস্তি কিছুটা লঘু হলেও তাতে সামাজিকভাবে তার সম্ভ্রম অধিক নষ্ট হয় বলে প্রকাশ্য শাস্তিতকে সে বেশি ভয় করে।
কাজেই অপরাধ প্রতিরোধের কৌশল আত্মস্থ ও কার্যকর করার মাধ্যমেই সম্ভব ইনসাফভিত্তিক ভারসাম্যপূর্ণ আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। তাই ইসলাম অন্যান্য বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এমন এক বাস্ততবধর্মী ও ইনসাফপূর্ণ বিচার ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে ধনী-গরীব, আমীর-ফকির ও আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অপরাধ নির্মূলের ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। অতীতে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার ফলে তৎকালীন সমাজ পরিণত হয়েছিল সভ্যতার সোনালী সমাজে। যেখানে যালিম পেত যুলুমের উপযুক্ত শাস্তিত এবং মাযলুম লাভ করত প্রশান্তি। এসম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী- وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ ‘কিসাস (শান্তি বিধান) এর মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন’ (বাক্বারাহ ২/১৭৯)।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থা কী?
জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা এবং জনগণের সম্পদ বা অধিকার অন্যায়ভাবে হরণ করা হ’লে সেই সংক্রান্ত বিচারে বাদীর সম্পদ ও অধিকার তার হাতে ফিরিয়ে দেয়াই হচ্ছে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। জনগণের মাঝে বিরোধ নিষ্পত্তি, সামাজিক অধিকারের জন্য ক্ষতিকর সবকিছু প্রতিহত করা এবং জনগণ ও সরকারের মধ্যে উদ্ভূত বিরোধ নিষ্পত্তি করার মূলনীতিই হ’ল ইসলামী বিচার ব্যবস্থা। প্রত্যেক মানুষই এই নিরাপত্তা কামনা করে যা শুধুমাত্র ইসলাম নিশ্চিত করে। যে কোন পুরুষ বা নারী তার জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম ইত্যাদির নিরাপত্তা চায়। আর ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন ব্যবস্থাপনা এসব নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে না বরং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে প্রায়ই এসব নিরাপত্তার লংঘন এবং অপব্যবহার ঘটে থাকে। বিশেষতঃ অন্যায়, ধর্ষণ, চুরি, গুম, হত্যা ইত্যাদি এবং সেই সাথে এই সকল সমস্যার সমাধানহীন জীবন ব্যবস্থায় কোনভাবেই পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক প্রশান্তি অর্জন সম্ভব নয়।
তাই বলা যায়- ‘যে ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের বিরোধপূর্ণ বিষয় সমূহ আল্লাহ কর্তৃক প্রনীত আইন ও রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রদর্শিত নীতি অনুযায়ী ফায়ছালা করা হয় সেটাই ইসলামী বিচার ব্যবস্থা’।
বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা :
বিচার ব্যবস্থা কতটা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জানা যায়। গোটা মুসলিম উম্মাহ এর আবশ্যকতা সম্পর্কে একমত।
শরী‘আতের অনেক বিষয় অকাট্য প্রমাণ তথা কুরআন সুন্নাহর মাধ্যমে জানা যায়। আর কিছু বিষয় রয়েছে যাতে ইজতিহাদ (গভীর জ্ঞান গবেষণা) করার অবকাশ থাকে। মুসলমানদের জীবনে বিশেষ করে তাদের সামাজিক সমস্যাবলীর মধ্যে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার সমাধান একমাত্র কাযী বা বিচারকের বিচারের মাধ্যমেই হ’তে পারে। যেমন কোথাও বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হওয়ার কারণ প্রকাশ পেল অথবা বিয়ের পর উভয়ের মধ্যে দুধপান জনিত সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেল। আর উভয় অবস্থায়ই স্বামী তার স্ত্রীকে ত্যাগ করতে রাজি নয় ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে কাযীর ফয়সালা ছাড়া বিকল্প কোন পন্থা নেই। এমতাবস্থায় এ কথাটি সুস্পষ্ট যে, এসব মতবিরোধের অবসান কল্পে একটা সিদ্ধান্তকারী ফয়সালা এবং অকাট্য নির্দেশ অপরিহার্য। অন্যথায় গোটা সমাজ অবৈধ কর্মকান্ড ও নিকৃষ্ট পাপের আবাসস্থলে পরিণত হবে। অতএব কুরআন, সুন্নাহ, প্রমাণাদির ভিত্তিতে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য কর্তব্য’।[1]
আল কুরআনের আলোকে বিচার ব্যবস্থার হুকুম :
সমগ্র জগতের একচ্ছত্র মালিকানা যেহেতু মহান আল্লাহ তায়ালার , সেহেতু হুকুমও চলবে তাঁর। সৃষ্টি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন তার শরীক নেই তেমনই হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রেও কাউকে শরীক করার অবকাশ নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, -لِلَّهِ الْأَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَمِنْ بَعْدُ ‘পূর্বাপর সমস্ত নির্দেশ দেওয়ার (ফয়সালা করার) ক্ষমতা কেবল আল্লাহ তায়ালার (রূম-৩০/০৪)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম (বিচার ব্যবস্থা) চলতে পারে না। (ইউসুফ-১২/৪০) আইন প্রণেতা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং বিচার কার্জ পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান লংঘন করার অধিকার কারো নেই। ইরশাদ হচ্ছে:أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ- ‘শুনে নাও, সৃষ্টি একমাত্র তাঁরই। আর তিনিই একমাত্র হুকুম দেয়ার মালিক’ (আ‘রাফ-৭/৫৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমনাতসমূহ প্রাপকের নিকট পৌছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী’ ( নিসা ৪/৫৮)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে অবর্তীণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিদ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নেবেন কে তাকে ও তার রাসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী’ (হাদীদ-২৫)।
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ-
‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই আল্লাহভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত’ (মায়েদাহ ৫/০৮)।وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُونَ- ‘যখনই তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তাদের পরস্পর বিরোধ মীমাংসা করার জন্য, তখন তাদের একটি দল পাশ কেটে সরে পড়ে’ (নূর-২৪/৪৮)।
সুন্নাহর আলোকে বিচার ব্যবস্থার হুকুম :
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা পবিত্র কুরআন মাজীদের পাশাপাশি সুন্নাহর মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিক-নির্দেশনা মেনে চলা অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে অমান্য করা মানেই আল্লাহকে অমান্য করা। আমীর বা নেতার আনুগত্য করা রাসূলের আনুগত্যের শামিল। যেমন হাদীছে এসেছে,عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ، إِلَّا أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ- ‘মনঃপুত হোক বা নাই হোক উভয় অবস্থায় তার নির্দেশ শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ততক্ষন অপরিহার্য, যতক্ষন না সে কোন গুনাহের কাজ করতে নির্দেশ দেয়। কোন গুনাহের কাজের নির্দেশ দিলে সে বিষয়ে তাঁর কোন কথা শ্রবণ করা বা নির্দেশ পালন করা যাবেনা’।[2] সুতরাং দায়িত্বশীল অধীনস্ততকে কোন নির্দেশ দিলে চাই তা তার মনঃপুত হোক বা নাই হোক সকল অবস্থায় সে উক্ত নির্দেশ পালন করে যাবে। যতক্ষন না কোন গুনাহের কাজের নির্দেশ দেয়া না হয়। যেহেতু গুনাহের কাজের নির্দেশ অনুসরণ যোগ্য নয়। অন্যত্র হাদীছে এসেছে, عن أبي هريرة أن رسول الله صلي الله عليه وسلم قال من أطاني فقد أطاع الله ومن عصني فقط عصي الله ومن أطاع أميري فقد أطاعني ومن عصي أميري فقد عصني- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর অনুগত্য করল। যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে আমার আমীরের আদেশ মান্য করল, সে আমার আদেশ মান্য করল। যে আমার আমীরের আদেশ অমান্য করল সে আমার আদেশ অমান্য করল’।[3]
ইসলামের আলোকে সুবিচার না করার পরিণতি :
শারঈ বিচার ব্যবস্থা অনুসরণ না করে নিজের খেয়াল খুশি মত বিচারকার্য পরিচালনার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন,تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ- ‘এই সব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এটাই মহা সাফল্য। আর কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তার নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে (নিসা ৪/১৩-১৪)।
আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আতই হচ্ছে বিচার-ফয়ছালার মূল ভিত্তি অথচ বর্তমান গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদেরকে আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়া হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের মতামত রাষ্ট্রীয় আইনের মর্যাদা পায়। তারা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল ঘোষণা দেয়ার অধিকার রাখে। এটা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। পবিত্র কুরআনে যা কুফর, যুলুম এবং নাফরমানী বা অবাধ্যতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী যারা বিচার ফয়ছালা করে না তারই কাফির, ফাসিক, যালিম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ-‘আমরা তাওরাত নাযিল করেছিলাম। যাতে হেদায়াত ও নূর ছিল। আল্লাহর অনুগত নবীগণ, আল্লাহওয়ালাগণ ও আলেমগণ তা দ্বারা ইহূদীগণের মধ্যে ফায়ছালা দিতেন। কেননা তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের হেফাযতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর তারা এ ব্যাপারে সাক্ষী ছিল। অতএব তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াত সমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। মনে রেখ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারা কাফের। আর আমরা তাদের উপর বিধিবদ্ধ করেছিলাম যে, জীবনের বিনিময়ে জীবন, চোখের বদলে চোখ, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখম সমূহের বিনিময়ে যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সেটি তার জন্য কাফফারা হয়ে যায়। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারা যালেম’ (মায়িদা-৫/৪৪-৪৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ- ‘অর্থাৎ যারা আল্লাহর আইনানুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা ফাসিক’ (মায়িদা-৫/৪৭)।
ইসলামের আলোকে সুবিচার করার প্রতিদান :
১. ন্যায়বিচারকের জন্য আল্লাহ সত্যনিষ্ঠ মন্ত্রী নিযুক্ত করে দেন : হাদীছে এসেছে,عَن عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنهَا، قَالَت: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم: إِذَا أرَادَ اللهُ بِالأَمِيرِ خَيْراً، جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ صِدقٍ، إنْ نَسِيَ ذَكَّرَهُ، وَإنْ ذَكَرَ أعَانَهُ، وَإِذَا أرَادَ بِهِ غَيْرَ ذَلِكَ جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ سُوءٍ، إنْ نَسِيَ لَمْ يُذَكِّرْهُ، وَإنْ ذَكَرَ لَمْ يُعِنْهُ আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ কোন শাসকের মঙ্গল চান, তখন তিনি তার জন্য সত্যনিষ্ঠ (শুভাকাঙ্খী) মন্ত্রী নিযুক্ত করে দেন। শাসক (কোন কথা) ভুলে গেলে সে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং স্মরণ থাকলে তার সাহায্য করে। আর যখন আল্লাহ তার অন্য কিছু (অমঙ্গল) চান, তখন তার জন্য মন্দ মন্ত্রী নিযুক্ত করে দেন। শাসক বিস্মৃত হলে সে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় না এবং স্মরণ থাকলে তার সাহায্য করে না’।[4]
২. ইনসাফের সাথে বিচারক সঠিক সিন্ধান্তে উপনীত হ’তে ব্যর্থ হলেও নেকী পায় : হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ وَاحِدٌ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, কোন বিচারক যখন বিচার কার্য করে এবং এই বিষয়ে সে চুড়ান্ত প্রয়াস পায় আর এতে যদি তার রায় সঠিক হয় তবে তার জন্য হ’ল দু’টি ছাওয়াব। আর যদি সে বিচারে ভুল করে তবে তার জন্য হল একটি ছওয়াব’।[5]
৩. বিচারের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয়কারী দায়ী হয়, বিচারক দায়ী হয় না : হাদীছে এসেছে, عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ، وَإِنَّكُمْ تَخْتَصِمُونَ إِلَيَّ وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَلْحَنَ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ، فَأَقْضِيَ لَهُ عَلَى نَحْوِ مَا أَسْمَعُ مِنْهُ، فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ بِشَيْءٍ، فَلَا يَأْخُذْ مِنْهُ شَيْئًا، فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ উম্মু সালামাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি তো একজন মানুষ। তোমরা আমার নিকট তোমাদের মোকদ্দমা পেশ করে থাকো। হয় তো তোমাদের এক পক্ষ অপর পক্ষের চেয়ে অধিক বাকপটুতার সাথে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে থাক। ফলে আমি তার বিবরণ অনুসারে তার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকি। এভাবে আমি যদি তাদের কোন ভাইয়ের হক থেকে কিছু অংশ তাকে দিয়ে দেই, তবে সে যেন তা কখনো গ্রহণ না করে। কারণ আমি তাকে এভাবে আগুনের একটি টুকরাই দিলাম’।[6]
৪. মহান আল্লাহ হলেন ন্যায়বিচারকের সাহায্যকারী :
হাদীছে এসেছে, عَنْ عَلِيٍّ عَلَيْهِ السَّلَام، قَالَ: بَعَثَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْيَمَنِ قَاضِيًا، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ تُرْسِلُنِي وَأَنَا حَدِيثُ السِّنِّ، وَلَا عِلْمَ لِي بِالْقَضَاءِ، فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ سَيَهْدِي قَلْبَكَ، وَيُثَبِّتُ لِسَانَكَ، فَإِذَا جَلَسَ بَيْنَ يَدَيْكَ الْخَصْمَانِ، فَلَا تَقْضِيَنَّ حَتَّى تَسْمَعَ مِنَ الْآخَرِ، كَمَا سَمِعْتَ مِنَ الْأَوَّلِ، فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يَتَبَيَّنَ لَكَ الْقَضَاءُ، قَالَ: فَمَا زِلْتُ قَاضِيًا، أَوْ مَا شَكَكْتُ فِي قَضَاءٍ بَعْدُ আলী (রাঃ) বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে ইয়ামেনে বিচারক হিসাবে প্রেরণ করলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে বিচারক করে ইয়ামেনে পাঠাচ্ছেন, অথচ আমি একজন নওজোয়ান, বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তিনি বলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার অন্তরকে সঠিক সিদ্ধান্তেতর দিকে পথ দেখাবেন এবং তোমার কথাকে প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। যখন তোমার সামনে বাদী-বিবাদী বসবে তখন তুমি যেভাবে এক পক্ষের বক্তব্য শুনবে অনুরূপভাবে অপর পক্ষের বক্তব্য না শোনা পর্যস্ত কোন সিদ্ধাস্ত নিবে না। এতে তোমার সামনে মোকদ্দমার আসল সত্য প্রকাশিত হবে। আলী (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি সিদ্ধান্তত গ্রহণে সন্দেহে পতিত হইনি’।[7]
৫. সত্য জেনে ফয়ছালাকারী বিচারক জান্নাতী :
হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ: وَاحِدٌ فِي الْجَنَّةِ، وَاثْنَانِ فِي النَّارِ، فَأَمَّا الَّذِي فِي الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ، وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِي الْحُكْمِ، فَهُوَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِي النَّارِ- ইবনু বুরাইদাহ (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দু’ প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হ’ল, যে সত্যকে বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে যুলুম করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারক অজ্ঞতাপ্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী’।[8]
৬. ন্যায়পরায়ণ শাসক আরশের নিচে ছায়া পাবে :
হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ الْإِمَامُ الْعَادِلُ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। নবী (ছাঃ) বলেন, যে দিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক। ২. সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে। ৩. সে ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। ৪. সে দু’ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে। একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য। ৫. সে ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহবান জানায়, কিন্তু সে এ বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’। ৬. সে ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না। ৭. সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকর করে, ফলে তার দু’ চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে’।[9]
৭. সত্যনিষ্ঠ বিচারক ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট তাঁর ডানপাশে নূরের মিম্বারের উপর অবস্থান করবে :
হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:إِنَّ الْمُقْسِطِينَ عِنْدَ اللَّهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ عَنْ يَمِينِ الرَّحْمَنِ وَكِلْتَا يَدَيْهِ يمينٌ الذينَ يعدِلُونَ فِي حُكمِهم وأهليهم وَمَا ولُوا- ‘আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় সত্যনিষ্ঠ বিচারক আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁর ডানপাশে নূরের মিম্বারের উপর অবস্থান করবে। যদিও আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাতই ডান (কল্যাণকর)। তারা হ’ল সে সমস্ত বিচারক- যারা তাদের বিচারালয়ে, নিজেদের পরিবার-পরিজনদের মাঝে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে’।[10]
(ক্রমশঃ)
[লেখক : কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’]
[1]. ইসলামী বিচার ব্যবস্থা, পৃ: ৩৫।
[2]. মুসলিম হা/১৮৩৯।
[3]. বুখারী হা/৬৭১৮।
[4]. আবু দাউদ হা/২৯৩২; নাসায়ী হা/৪২০২।
[5]. বুখারী হা/৭৩৫২; ইবনু মাজাহ হা/২৩১৪; তিরমিযী হা/১৩২৬।
[6]. আবু দাউদ হা/৩৫৮৩।
[7]. আবু দাউদ হা/৩৫৮২।
[8]. আবু দাউদ হা/৩৫৭৩।
[9]. বুখারী হা/৬৬০।
[10]. মিশকাত হা/৩৬৯০।