অধিকাংশ সমাচার (৪র্থ কিস্তি)

লিলবর আল-বারাদী 558 বার পঠিত

৮. শিশু বক্তাদের নিকট থেকে জ্ঞান আহরণে বিরত থাকা : জ্ঞান কার নিকট হ’তে গ্রহণ করা হচ্ছে, তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা ইলম বা জ্ঞান হ’ল দ্বীনের স্বরূপ। যেখানে দ্বীন নেই, সেখানে জ্ঞানও নেই। মুহাম্মাদ বিন সিরীন (রাঃ) বলেন, إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ ‘নিশ্চয়ই এ জ্ঞান দ্বীন স্বরূপ। সুতরাং তোমরা লক্ষ্য রাখবে কার নিকট হ’তে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ’।[1] 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কুরআনুল কারীমের মধ্যে أَكْثَرَ (আকছারা) অর্থাৎ ‘অধিকাংশ’ বা ‘বেশির ভাগ’ (Almost) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ‘অধিকাংশ’ শব্দ ব্যবহার করে তিনি মানুষকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন। ‘অধিকাংশ’ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ‘কিন্তু অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে অবগত নয়’ (ইউসুফ ১২/৬৮), ‘অধিকাংশ অবহিত নয়’ (আন‘আম ৬/৩৭), ‘কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না’ (আরাফ ৭/১৩১), অন্যত্র তিনি বলেন, وَأَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ ‘আর তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না’ (মায়িদা ৫/১০৩), কেননা,وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ يَجْهَلُونَ ‘তাদের অধিকাংশই মূর্খ’ (আন‘আম ৬/১১১)। বর্তমানে দুনিয়ার অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, দুনিয়াতে অধিকাংশ ব্যক্তি দুনিয়ার মরীচিকাময় মাল, মর্যাদা, নারীসহ যাবতীয় মোহ ফেৎনায় নিপতিত হয়েছে। যার ফলে অধিকাংশ মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ক্রমে ক্রমে মানুষ ঈমানের দ্বীপ্ততা ও আমলের তৃপ্তি হারিয়ে ফেলছে। তবে আল্লাহ তা‘আলা কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন সেই সকল ব্যক্তি ব্যতীত। এই অধিকাংশ ব্যক্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

১. অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত :

অধিকাংশ মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, وَالْعَصْرِ. إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ. ‘কালের শপথ! নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে’ (আছর ১০৩/১-২)। আল্লাহ তা‘আলা কালের শপথ এই জন্য বলেছেন যে, মানুষের কৃতকর্মের সময়কাল অতীব স্বল্প পরিসরে। আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত যতটুকু সময় ঠিক ততটুকু সময় মানুষের জীবনে রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকাল সম্পর্কিত যা বান্দার ভাল-মন্দ সকল কর্মই শামিল হবে।

তাছাড়া আছরের ওয়াক্ত হ’তে কুরায়েশ নেতারা ‘দারুন নাদওয়াতে’ পরামর্শসভায় বসত এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে ভাল-মন্দ সিদ্ধান্ত নিত। মন্দ সিদ্ধান্তের কারণে লোকেরা এই সময়টাকে ‘মন্দ সময়’ (زمان سوء) বলত’ (ক্বাসেমী)। এখানে আছর-এর শপথ করে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, কালের কোন দোষ নেই। দোষী হ’ল মানুষ।[2] আবার পৃথিবীর সকল মানুষ কৃতকর্মের পরিণতি ক্ষতির মধ্যে নিপতিত রয়েছে। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَذَاقَتْ وَبَالَ أَمْرِهَا وَكَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهَا خُسْرًا ‘অতঃপর তারা তাদের কৃতকর্মের আযাব আস্বাদন করল। বস্ত্ততঃ ক্ষতিই ছিল তাদের কর্মের পরিণতি’ (তালাক ৬৫/৯)। প্রত্যেক মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে রয়েছে। যেমন, শিরক, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে উপেক্ষা, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব অবিশ্বাস, পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থসমূহ ও নবী-রাসূলদের অবজ্ঞা, দুনিয়ার কর্মফল দিবস আখিরাত ও তাক্বদীরের ভাল-মন্দ অবিশ্বাস ইত্যদির দরুণ। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস আশ-শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) বলেন, ‘যদি মানুষ এই সূরাটি গবেষণা করত, তাহ’লে এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট হ’ত’ (ইবনু কাছীর)।

এই সূরার আলোকে সকলকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছায়ে দিন। মূল শিক্ষা হ’ল- তবে প্রথমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে’। কিন্তু এর পরেই চারটি শর্ত দিয়ে তিনি বলেন, إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ‘তারা ব্যতীত যারা (জেনে-বুঝে) ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দিয়েছে’ (আছর ১০৩/৩)। শর্ত চারটি হ’ল- ঈমান, আমল, দাওয়াত ও ছবর। এই চারটি গুণ যার মধ্যে রয়েছে সে ক্ষতি থেকে নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত।

(এক) ঈমান এনেছে : প্রথম গুণ তুলে ধরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا ‘তারা ব্যতীত যারা (জেনে-বুঝে) ঈমান এনেছে’ (আছর ১০৩/৩)। বান্দা মুমিন হওয়ার চূড়ান্ত শর্ত হ’ল ঈমান আনয়ন করা। ‘ঈমান’ অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, নিরাপত্তা দেওয়া, যা ভীতির বিপরীত।[3] রাগেব আল-ইছফাহানী (রহঃ) বলেন, ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া’।[4] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে’।[5] মুমিনের বিশ্বাসের ভিত্তি ছয়টি। যথা- أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. ‘আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম (১) আল্লাহর উপরে (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপরে (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) তাঁর রাসূলগণের উপরে (৫) ক্বিয়ামত দিবসের উপরে এবং (৬) আল্লাহর পক্ষ হ’তে নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে’।[6]

মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ- 

‘রাসূল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর, আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল’(বাক্বারাহ ২/২৮৫)। পরিশেষে ঈমান আনতে হবে এবং এর ওপর দৃঢ়ভাবে অবস্থান করতে হবে। আর সকল বিশ্বাসের সাথে সঠিক আক্বীদা পরিশুদ্ধ রাখতে হবে।

(দুই) সৎ আমল করে : ঈমানের চূড়ান্ত শর্ত মেনে নেয়া পরেই মুমিনের গুণাবলী অর্জনের জন্য যে শর্ত পালনীয় সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ‘আর সৎকর্ম সম্পাদন করেছে’ (আছর ১০৩/৩)। ঈমান আনয়নের পরেই বান্দার নাজাতের দ্বিতীয় শর্ত হ’ল আমলে ছালেহ সম্পাদন করা। ঈমান হ’ল মূল এবং আমল হ’ল শাখা, এ দু’টি না থাকলে পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যাতে তারা তাদের ঈমানের সঙ্গে ঈমান মজবুত করে নেয়’ (ফাতাহ ৪৮/৪)। তিনি আরো বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيْرُ ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাদের জন্য এমন জান্নাত রয়েছে, যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান। আর এটাই হচ্ছে বড় সফলতা’ (বুরূজ ৮৫/১১)। অন্যত্র বলেন, وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيْمٌ- ‘যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে তাদের প্রতি আল্লাহর ওয়াদা এই যে, আল্লাহ তাদের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করবেন এবং তাদের বড় প্রতিফল দিবেন’ (মায়েদাহ ৫/৯)। ঈমানের দ্বীপ্ততা বৃদ্ধির জন্য সর্বদা খালিছ অন্তরে বেশী বেশী আমলে ছালেহ পালন করতে হবে। যাতে করে দো‘আ, যিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে ঈমানের শানিত ধার আরো উজ্জ্বল হয়।

(তিন) হক্বের উপদেশ দেয় : ঈমান আনয়ন ও আমলে ছালেহ প্রতিপালনের মাধ্যমে দ্বীন প্রচার ও প্রসারে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা। অর্থাৎ হক্বের উপদেশ দেয়া। আর এটা হ’ল নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির তৃতীয় গুণাবলী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ ‘আর পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে’ (আছর ১০৩/৩)।

মানুষ বিবেকবান জীব হলেও প্রাথমিকভাবে অবুঝ প্রাণী। যখনি তার বুদ্ধিমতার বহিঃপ্রকাশের সাথে সঠিক বুঝ হবে, তখনি সে হয় দ্বীনের অথবা শয়তানের পথে হাটতে শুরু করবে। যে ব্যক্তি দ্বীনের সঠিক পথে চলবে তাকে সাধুবাদ। কিন্তু যে ব্যক্তি তাগুদের পথে চলবে তাকে দ্বীনের দাঈ ব্যক্তিরা সর্বদা দ্বীনের নছীহত করবে। আর উপদেশ দানকারীদের মধ্যে সেই উত্তম যে অন্যের নিকট থেকে দুঃখ-কষ্ট পেয়েও দ্বীনের দাওয়াত প্রদানে ছবর করে এবং অনঢ় থাকে। কখনও কোন অবস্থাতে অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করে না, হেয় প্রতিপন্ন করে না, বৈষ্যয়িক বিষয়ে বাড়াবাড়ী করে না, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে ইত্যাদি গুণ বিদ্যমান কেবল তারাই সফলকাম।

মানুষকে প্রজ্ঞা ও হিকমাতের সাথে সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ.

‘তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয়ই একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন’(নাহল ১৬/১২৫)। একজন ব্যক্তিকে হেদায়াতের পথে আনতে পারলে আপনি সমপরিমাণ নেকীর ভাগ পাবেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ ‘কোন ব্যক্তি যদি ভালো কাজের পথ দেখায়, সে ঐ পরিমাণ নেকী পাবে, যতটুক নেকী পাবে ঐ কাজ সম্পাদনকারী নিজে’।[7]

সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধের সেনাপতি আলী বিন আবু তালিব (রাঃ)-কে নছীহতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَوَاللهِ لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِداً خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম! তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটা তোমার জন্য লাল উটের (কুরবানীর) চেয়েও উত্তম হবে’।[8]

অবশেষে আপনি সফল না হলে বিদায় হজ্জের ভাষণের এই অংশটি মনে করে সান্ত্বনা গ্রহণ করবেন যে, আপনি আপনার দায়িত্ব পালনে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ প্রদান করে বলেন, أَلَا لِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ ‘উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়’।[9]

নিজেকে পরিশুদ্ধ করে পরিবার ও আত্মীয়দের মধ্যে হক্বের উপদেশ দিতে হবে। উপদেশ প্রদানের সময় তাদের নিকট থেকে বাঁধা ও বিপত্তি আসতে পারে। আর সে সময় নিজেকে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনাদর্শের মানদন্ডে ওযন করে অতীব সূক্ষ্মভাবে ধৈর্য্যধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে এবং দাওয়াতের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।

(চার) ধৈর্য্যধারণের উপদেশ দেয় : দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতি থেকে নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চতুর্থ শর্ত হ’ল ধৈর্য্যধারণ করা। আর তা নিজে অবলম্বন করবে এবং অপরকে ছবর করতে উৎসাহিত করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ‘আর পরস্পরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দিয়েছে’ (আছর ১০৩/৩)। ‘ছবর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাঁধা দেয়া ও অনুবর্তী করা। যেমন- এক. যাবতীয় গুণাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা। দুই. সৎকাজ করা এবং এর ওপর অবিচল থাকা। তিন. বিপদাপদে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।[10] দুনিয়াতে যে যতবেশী ধৈর্য্যশীল, আখেরাতে সে ততবেশী কল্যাণকামী। আবূ মালেক আল-হারেস ইবনু আসেম আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন, وَالصَّلَاةُ نُورٌ، وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ، وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ، وَالقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ، كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا ‘ছালাত হ’ল নূর, ছাদকা হ’ল প্রমাণ, ছবর উজ্জ্বল আলো, আর কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ। প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আত্মার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে সকাল শুরু করে। আর তা হয় তাকে আযাদ করে দেয় অথবা তাকে ধ্বংস করে দেয়’।[11] দুনিয়ার বুকে মানুষ যত কম লোভ-লালসা করবে, ততবেশী ধৈর্য্যশীল হিসাবে গড়ে উঠবে।

ইবরাহীম বিন আদহাম (রহঃ) বলেন, ‘কম লোভ-লালসা, সত্যবাদীতা ও পরহেযগারিতার জন্ম দেয় এবং অধিক লোভ-লালসা, দুঃখ-কষ্ট ও অধৈর্যশীল সৃষ্টি করে’।[12]

হক্বের দাওয়াত বা উপদেশ প্রদানের সময় যে বাঁধা-বিপত্তি আসবে, সেখানে ছবরের সাথে অবিচল থাকতে হবে। এটা মহৎ গুণ। সবায় এ গুণ অর্জন করতে সক্ষম নয়। তবে প্রত্যেক মুমিনের এই গুণ অবশ্যই অর্জন করতে হবে, নতুবা সে পরাজিত হবে। সফলতা তারাই অর্জন করেছে যারা ছবর করেছেন। এটা ঈমানের পরীক্ষাও হ’তে পারে এবং সেখানে সর্বদা ধর্য্যধারণ করতে হবে। তাই তো বাঁধা না থাকলে দ্বীনের দাঈ অনুভব করতে পারবে না যে, তার দাওয়াত কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে। প্রত্যেক নবী-রাসূলের জীবনে এমনটি ঘটেছে। বর্তমানে এটা স্বাভাবিক। আর এর ফলাফল হবে অতীব সুস্বাদু। শুধু মাত্র ধৈর্য্যধারণ করতে হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা বৈ কিছুই নয়।

২. অধিকাংশ মানুষ মুমিন নয় :

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ ‘আর এমন কতক মানুষ রয়েছে, যারা বলে আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি। অথচ তারা বিশ্বাসী নয়’(বাক্বারাহ ২/৮)।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,أَوَكُلَّمَا عَاهَدُوا عَهْدًا نَبَذَهُ فَرِيقٌ مِنْهُمْ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ ‘কি আশ্চর্য! যখন তারা কোন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হ’ল তখনই তাদের একদল তা ভঙ্গ করল। বরং তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করেনা’(বাক্বারাহ ২/১০০)।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, ‘আর যে সকল দল তা অস্বীকার করে, আগুনই হবে তাদের প্রতিশ্রুত স্থান। সুতরাং তুমি এতে মোটেও সন্দেহের মধ্যে থেকো না, নিশ্চয় তা তোমার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে না’(হুদ ১১/১৭)।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ‘আর তুমি আকাঙ্খা করলেও অধিকাংশ মানুষ মুমিন হবার নয়’(ইউসুফ ১২/১০৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি আপনি যমীনের অধিকাংশ লোকের কথামত চলেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে’ (আন‘আম ৬/১১৬)। সুতরাং অধিকাংশ মানুষ ঈমান না আনলে আপনার কিছু করার নেই। আপনি চাইলেই কাউকে হিদায়াত দিতে পারবেন না’ (কুরতুবী)

‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করে না’ (আল-মুমিন : ৫৯)

মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)।

ক. প্রতিবেশীর হক্ব নষ্টকারী :

প্রতিবেশীর বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা, হৃদয়গ্রাহী হাহাকার, করুণ আর্তনাদ যার মনে রেখাপাত করে না, এমনকি স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তাদেরকে কষ্ট দিতে কুন্ঠিত হয় না, সে পূর্ণ মুমিন হ’তে পারে না। যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর ক্ষতি করে সে কখনও মুমিন হ’তে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শপথ করে তিনবার বলেন, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ ، وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ ، وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ. قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الَّذِى لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ. ‘আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কে সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না’।[13]

প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে তাকে খাদ্য না দিয়ে নিজে পেট পুরে খাওয়া ঈমানদারের পরিচয় নয়। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِىْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ. ‘ঐ ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায়, অথচ আর তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’।[14] আর প্রতিবেশীকে কষ্ট দানকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ. ‘সেই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে থাকে না’।[15]

আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে যারা বিশ্বাস করে তারা যেন বর্ণিত হাদীছের প্রতি যত্নশীল হয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا يُؤْذِ جَارَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَصِلْ رحِمَه. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানের সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। এরপর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন অবশ্যই ভালো কথা বলে, নতুবা যেন চুপ থাকে। অতঃপর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন অবশ্যই আত্মীয়দের হক আদায় করে’।[16]

প্রতিবেশীর গুরুত্ব কতবেশী যে সর্বদা জিবরীল (আঃ) এসে রাসূল (ছাঃ) প্রতিবেশীর হক পরিপূর্ণভাবে আদায়ের প্রতি নছীহত করতেন। আয়েশা ও ইবনু উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِى بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ. ‘জিবরীল (আঃ) সর্বদা আমাকে প্রতিবেশীর অধিকার পূর্ণ করার উপদেশ দিতে থাকতেন। এমনকি আমার ধারণা হয়েছিল যে, তিনি প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী ঠিক করে দেবেন।[17] যারা প্রতিবেশীর হক্বের প্রতি অনীহা-অবহেলা পোষণ করে এবং তাদেরকে ক্ষুধার্ত রাখে ও কষ্ট দেয় তারা প্রকৃত মুমিন নয়।

খ. হিংসুক :

মানুষের অন্তরে ঈমান অথবা হিংসা এদুয়ের একটি বিদ্যমান থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَجْتَمِعَانِ فِىْ قَلْبِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالْحَسَدُ ‘কোন বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হ’তে পারে না’।[18]

হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণকারীর সাথে দ্বীন থাকে না। এই ব্যক্তি নিজের নফস থেকে দ্বীনকে ছাফ করে ফেলে। যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِىَ الْحَالِقَةُ ‘তোমাদের মধ্যে পিপীলিকার ন্যায় প্রবেশ করবে বিগত উম্মতগণের রোগ। আর তা হ’ল হিংসা ও বিদ্বেষ। যা হ’ল ছাফকারী। لاَ أَقُوْلُ تَحْلِقُ الشَّعْرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّيْنَ ‘আমি বলিনা যে চুল ছাফ করবে, বরং তা দ্বীনকে ছাফ করে ফেলবে’।[19]

হিংসা ও বিদ্বেষ ষড়যন্ত্রের মূলমন্ত্র। তাই রাসূল (ছাঃ) সর্বদা হিংসা ও বিদ্বেষ পরিহার করে একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষা করতে বলেছেন। আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا وَلاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ-  ‘তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিংসা করো না, ষড়যন্ত্র করো না ও সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পরস্পরে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও। কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাই থেকে তিন দিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে থাকবে’।[20] পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক রক্ষার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ সকলে ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০)।

আর যারা পরস্পরের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ অন্তরে পোষণ করে না আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে ঈমানের নূর জ্বালিয়ে তা পরিপূর্ণ করে দেন। আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيْمَانَ ‘যে আল্লাহর জন্য অপরকে ভালবাসে ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ করে, আল্লাহর জন্য দান করে ও আল্লাহর জন্য বিরত থাকে, সে তার ঈমানকে পূর্ণ করল’।[21] একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ صَدُوْقِ اللِّسَانِ ‘প্রত্যেক শুদ্ধহৃদয় ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে আমরা চিনতে পারি। কিন্তু শুদ্ধহৃদয় ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব? জবাবে তিনি বললেন, هُوَ التَّقِىُّ النَّقِىُّ لاَ إِثْمَ فِيْهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ ‘সে হবে আল্লাহভীরু ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়; যাতে কোন পাপ নেই, সত্যবিমুখতা নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই’।[22]

মানুষ নিজের কল্যাণ কামনা করলে যেন অন্যের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করা থেকে বিরত থাকে। যামরাহ বিন ছা‘লাবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا لَمْ يَتَحَاسَدُوْا ‘মানুষ অতক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরে হিংসা না করবে’।[23] হিংসুকের কুদৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রার্থনা করতে বলেন, وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই হিংসুকের অনিষ্টকারিতা হতে যখন সে হিংসা করে’ (ফালাক্ব ১১৩/৫)। সকাল-সন্ধ্যায় সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস তিনবার করে পাঠ করে হাতে ফুঁক দিয়ে গায়ে হাত বুলাতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ كُلَّ لَيْلَةٍ جَمَعَ كَفَّيْهِ ثُمَّ نَفَثَ فِيهِمَا فَقَرَأَ فِيهِمَا (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِهِ يَبْدَأُ بِهِمَا عَلَى رَأْسِهِ وَوَجْهِهِ وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِهِ يَفْعَلُ ذَلِكَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ. ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দু’হাত একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যতদূর সম্ভব দেহে তিনবার দু’হাত বুলাতেন’।[24]

গ. আমানতের খেয়ানতকারী :

আমানত দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার আমানত নেই, তার দ্বীন নেই; যার দ্বীন নেই, তার ঈমানও নেই। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন,قَلَّمَا خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- إِلاَّ قَالَ لاَ إِيمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ، وَلاَ دِينَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকট খুব কমই ভাষণ দিতেন যেখানে তিনি বলতেন না যে, ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারিতা নেই। আর ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই, যার অঙ্গীকার ঠিক নেই’।[25]

আমানত দ্বীনকে বুঝানো হয়েছে যে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَّحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولاً. ‘আমরা আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার নিকট এই আমানত পেশ করেছিলাম। অতঃপর তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং এ থেকে শংকিত হ’ল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল। বস্ত্ততঃ সে অতিশয় যালেম ও অজ্ঞ’ (আহযাব ৩৩/৭২)। জমহূর বিদ্বানগণ বলেন, الْأَمَانَةُ تَعُمُّ جَمِيعَ وَظَائِفِ الدِّينِ، ‘আমানত’ বলে দ্বীনের সকল প্রকার দায়িত্বকে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)

মুমিন কখনো খেয়ানতকারী ও মিথ্যাবাদী হ’তে পারে না। যারা এটা করে, তারা আসলে মুমিন নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى الْخِلاَلِ كُلِّهَا إِلاَّ الْخِيَانةَ وَالْكَذِبَ ‘মুমিন সকল স্বভাবের উপর সৃষ্টি হ’তে পারে খেয়ানত ও মিথ্যা ব্যতীত’।[26]

অঙ্গীকার পূর্ণ করা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَوْفُوْا بِالْعَهْدَ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُوْلاً ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (ক্বিয়ামতের দিন) তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৪)। ক্বিয়ামতের দিন অঙ্গীকার ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী ব্যক্তিদের ডেকে বলা হবে, هَذِهِ غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ. ‘এটি অমুকের সন্তান অমুকের বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত’।[27]

কিয়ামতের মাঠে খেয়ানতকারীর জন্য একটি পতাকা রাখা হবে, যা তার পিঠের পেছনে পুঁতে দেওয়া হবে। আর জনগণের খেয়ানতকারী সবচেয়ে বড় খেয়ানতকারী। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ عِنْدَ اسْتِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَفِي رِوَايَةٍ : لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرْفَعُ لَهُ بِقَدْرِ غَدْرِهِ أَلاَ وَلاَ غَادِرَ أَعْظَمُ غَدْرًا مِنْ أَمِيرِ عَامَّةٍ ‘প্রত্যেক খেয়ানতকারীর জন্য ক্বিয়ামতের দিন একটি ঝান্ডা থাকবে, যা তার পিঠের পিছনে পুঁতে দেওয়া হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তার খেয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী সেটি উঁচু হবে। সাবধান! জনগণের নেতার খেয়ানতের চাইতে বড় খেয়ানত আর হবে না’।[28]

সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা খেয়ানত করতে নিষেধ করে বলেন, يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَخُونُوا اللهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوآ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খেয়ানত করো না’ (আনফাল ৮/২৭)। অন্যত্র বলেন, وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ ‘আর যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে’ (মুমিনূন ২৩/৮; মা‘আরেজ ৭০/৩২)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا، ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথাযথ হকদারগণের নিকট পৌঁছে দাও’... (নিসা ৪/৫৮)।

আমাদের মনে রাখা উচিৎ ঈমানের দ্বীপ্তিশিখা চিরন্তন প্রজ্জ্বলিত রাখতে চাইলে অবশ্যই ঈমান মযবুতির প্রতি যত্নশীল হতে হবে এবং মুমিনের জীবন-যাপন করতে চাইলে জেলখানার জীবন বেছে নিতে হবে, কারণ মুমনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। আর এটাও স্মরণ রেখে দুনিয়াবী জীবন চলা উচিৎ যে, আমরা অধিকাংশ মানুষ ক্ষতি ও ধ্বংসের মধ্যে পতিত এবং ঈমান, আমল ও আল্লাহর কৃপা ছাড়া আখিরাতে পরিত্রাণ আশা করতে পারি না।

 (ক্রমশঃ)

[লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী ]


[1]. মুসলিম হা/১৪; মিশকাত হা/২৭৩; দারেমী হা/৪২৪; ছহীহ হাদীছ।

[2] .প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন (৩০তম পারা), পৃষ্ঠা-৪৫৮।

[3]. জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/২০৭১; ফিরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত, পৃঃ ১১৭৬।

[4]. আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৩৫।

[5]. আছ-ছারিম আল-মাসলূল, পৃঃ ৫১৯।

[6]. হাদীছে জিব্রীল, মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[7]. মুসলিম হা/১৬৭৭; আবূদাঊদ হা/৫১২৯; তিরমিযী হা/২৬৭১; ছহীহ হাদীছ; মিশকাত হা/২০৯।

[8]. বুখারী হা/৩০০৯; মুসলিম হা/২৪০৬; মিশকাত হা/৬০৮০।

[9]. বুখারী হা/৪৪০৬, ৫৫৫০; মুসলিম হা/১৬৭৯; ইবনু মাজাহ হা/২৩৪; ছহীহ হাদীছ।

[10].মাদারেজুস সালেকীন, ২/১৫৬

[11]. আহমাদ হা/২২৯৫৯; মুসলিম হা/২২৩; তিরমিযী হা/৩৫১৭; ছহীহ হাদীছ; মিশকাত হা/২৮১।

[12]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ১০/২৪১ পৃঃ।

[13]. বুখারী হা/৬০১৬; মিশকাত হা/৪৯৬২ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়।

[14]. শু‘আবুল ঈমান হা/৩৩৮৯; ছহীহুল জামি‘ হা/১১২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৯; মিশকাত হা/৪৯৯১।

[15]. মুসলিম হা/৪৬; ছহীহুল জামি‘ হা/৭৬৭৫; মিশকাত হা/৪৯৬৩।

[16]. বুখারী হা/৬৪৭৫; আবু দাউদ হা/৫১৫৪; মিশকাত হা/৪২৪৩

[17]. বুখারী হা/৬০১৫; মুসলিম হা/২৬২৫; আবু দাউদ হা/৫১৫২; তিরমিযী হা/১৯৪২-৪৩; মিশকাত হা/৪৯৬৪।

[18]. নাসাঈ হা/৩১০৯, সনদ হাসান।

[19]. মিশকাত হা/৫০৩৯।

[20]. বুখারী হা/৬০৭৬; মুসলিম হা/২৫৫৯; মিশকাত হা/৫০২৮।

[21]. আবুদাঊদ হা/৪৬৮১; তিরমিযী হা/২৫২১; মিশকাত হা/৩০।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত হা/৫২২১।

[23]. ত্বাবারাণী হা/৮১৫৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৮৬।

[24]. বুখারী হা/৫০১৭; মুসলিম, মিশকাত হা/২১৩২।

[25]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৪০৪৫; ছহীহুত তারগীব হা/৩০০৪; মিশকাত হা/৩৫ ।

[26]. মুসনাদ বাযযার হা/১১৩৯; মুসনাদ আবী ইয়া‘লা হা/৭১১; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৩২৮, হায়ছামী বলেন, রাবীগণ ছহীহ-এর রাবী; আহমাদ; মিশকাত হা/৪৮৬০

[27]. বুখারী হা/৬১৭৭; ‘মানুষকে তাদের পিতার নামে ডাকা হবে’ অনুচ্ছেদ-৯৯; মুসলিম হা/১৭৩৫; মিশকাত হা/৩৭২৫।

[28]. মুসলিম হা/১৭৩৮; মিশকাত হা/৩৭২৭ ‘নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা’ অধ্যায়।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও