দজলায় ভাসে গোলামের রিয্ক

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 299 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। আববাসী খলীফা মুতাওয়াক্কিলের ফাত্হী নামে এক গোলাম ছিল। ফাত্হীকে ছোট বেলায় যুদ্ধ বন্দীদের সাথে নিয়ে এসে বিক্রয় করা হয়েছিল। সে যুগে যুদ্ধ বন্দীদের দূরের শহরে এনে পশু-পাখির মত কেনাবেচা করা হ’ত। ধনী লোকেরা দাস হিসাবে তাদের ক্রয় করত। এই কৃতদাসদের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ছিল না। কেউ দয়া করে মুক্ত না করা পর্যন্ত তাদেরকে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হ’ত।

চতুর ফাত্হী গোলাম হ’লেও খুবই বুদ্ধিমান ছিল। খলীফার প্রাসাদে থেকে আদব-কায়দা শিখেছিল। খলীফার চোখে এতই প্রিয় হয়েছিল যে, তিনি তাকে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ফাত্হীকে শিষ্টাচার, ঘোড়ায় চড়া ও তিরন্দাযী শিখানোর প্রতি খলীফার প্রবল আগ্রহ ছিল। এমনকি তিনি তাকে সাঁতার কাটাও শিখাতে চাইতেন। কারণ যদি কখনো পানিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। এজন্য দু’জন সাঁতার প্রশিক্ষক আনা হয়। যারা প্রতিদিন ফাত্হীকে এক ঘন্টা সাঁতার শিখাত।

কিছুদিন যেতে না যেতেই ফাত্হী অহংকারী হয়ে উঠে। অনেক বাচ্চারাই কিছুটা শিখেই মনে মনে ভাবে সে সব কিছু জানে। ফাত্হীও ভাবে উস্তাদ হয়ে গেছে। তাই তার সাঁতার প্রশিক্ষকের দরকার নেই। একদিন ফাত্হী সাঁতারু শিক্ষকদের চোখ এড়িয়ে একাই দজলা নদীতে চলে যায়। নদীটি খলীফার প্রাসাদের পাশ দিয়েই বয়ে যেত। অতঃপর সাঁতার কাটার জন্য সে পানিতে নামে। ঘটনাক্রমে সেদিন দজলায় তীব্র স্রোত ছিল। ফাত্হী কিছুক্ষণ হাত-পা ছুড়ে বুঝতে পারে সে আর নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। বেশী চেষ্টা করতে গেলে ক্লান্ত হয়ে ডুবে যাবে। সে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ তার চিৎকার শুনে না। অবশেষে নিরুপায় হয়ে স্রোতের সাথে ভাসতে থাকে। যতটুকু সাঁতার শিখেছিল তা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায়, যেন তলিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভেসে থাকতে পারে। তা’হলে অন্তত কোন এক জায়গায় গিয়ে নদীর কিনারায় পৌঁছাতে পারলে রক্ষা পাবে। যেতে যেতে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে শহরের বাইরে চলে গেল। রাত হয়, দিন হয় আর সে এভাবেই হাত-পা নাড়াতে নাড়াতে চলতে থাকে। পরে একদিন এক যায়গায় পৌছায়, যেখানে দজলার পানির স্রোতে নদীর পাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। সেই ভাঙ্গা অংশের ফাঁটল ধরে কোন রকম রক্ষা পাওয়া যাবে। ফাত্হী অনেক চেষ্টা করে সেখানে গিয়ে ফাঁটলে হাত ঢুকিয়ে নিজেকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচায়। কিন্তু নদীর কিনারা বেয়ে উপরে ওঠার কোন পথ ছিল না। ক্লান্তি ও ক্ষুধায় নিঃসাড় হয়ে পড়ে। তারপরেও পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফাত্হী সেখানেই বসে পড়ে। কোন জনমানবের দেখা মেলে না। সকালের অপেক্ষায় সেখানেই রাতের আঁধার নেমে আসে। ফাত্হী একাধারে কয়েক দিন সেখানেই অবস্থান করে রাত কাটিয়ে দেয়।

অপরদিকে ফাত্হীকে সাঁতার শিখানোর জন্য প্রশিক্ষকরা আসে। কিন্তু তারা কেউ জানত না ফাত্হী কোথায়। কর্মচারীরা বাগানে ও প্রাসাদের কক্ষগুলোতে তাকে খোঁজ করে কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যায় না। মাদ্রাসায়, গোসলখানায়, ঘোড়া ও তীর চালনা প্রশিক্ষণের মাঠে এবং সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজা হয়। কিন্তু তার কোনই হদিস মেলে না। অবশেষে মুতাওয়াক্কিলকে খবর দেয়া হয় যে, ফাত্হীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব জায়গায় আমরা খুঁজেছি কিন্তু কেউ তার খোঁজ জানে না। মুতাওয়াক্কিল খুবই দুঃখ পান। প্রাসাদের সমস্ত দারোয়ানদের ডেকে হাযির করে কিন্তু কেউ ফাত্হীকে দেখেনি। তিনি এই দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে, নিজের ছেলে ঘোষণা করায় হয়ত কেউ তাকে হত্যা করেছে। তিনি বললেন, প্রাসাদের সমস্ত জায়গায় দ্রুত ঘোষণা করে দাও, যে ফাত্হীর খোঁজ পাবে সে যেন দ্রুত সে খবর খলীফার কাছে পৌঁছে দেয়। হায়! তার খবর কেউ জেনেও যদি না বলে!

তখনো ঘোষক রওনা হয়নি। এমন সময় ওয়াচ টাওয়ারের টহলদারদের প্রধান খবর পাঠায়। প্রহরীর টাওয়ার থেকে সকাল ৯ টায় একজনকে সাঁতার কাটার জন্য প্রাসাদ থেকে বের হ’তে দেখা গেছে। দ্রুত ডুবুরিরা খুঁজতে নেমে পড়ে। প্রহরীরা নদীর ঘাট ও তার আশেপাশে খুঁজাখুঁজি করে। কিন্তু কোন পোশাকের টুকরো পর্যন্ত খুঁজে পায় না। প্রাসাদের পোশাক ঘরেও অনুসন্ধান করা হয়। একজন কর্মচারী বলে, এক গোলামের পোশাক নদীর ঘাটে পড়ে ছিল। যেহেতু সেখানে কেউ ছিল না তাই ধারণা করা হয়েছিল কেউ নিজের পোশাক পরিবর্তন করে সেখানে রেখে চলে গেছে। পোশাকটা এনে যথাস্থানে রাখা হয়েছে। এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু ওয়াচ টাওয়ারের প্রহরীরা বলল, আজ একজন সাঁতারু প্রাসাদ থেকে বের হয়েছে। এবার কয়েকজন ডুবুরী বাইরে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে সেজন্য সার্বিক অবস্থা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়। মুতাওয়াক্কিল বললেন, ফাত্হী সাঁতার কাটার জন্য দজলায় গেছে আর পানি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পোশাকটা খলীফার কাছে আনা হলে বোঝা গেল সেটি ঐ গোলামের ছিল। খলীফা বললেন, হয় শহরের বাইরে কেউ ফাত্হীকে বাঁচিয়েছে নতুবা ডুবে গেছে। ঘোষকদের বল এই খবর শহরে ঘোষণা করা হোক। আর ডুবুরীদেরকে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে বল। দ্রুত ঘোষকরা শহরে ঘোষণা করে। ফাত্হী নামের খলীফার কাছের একজন হারিয়ে গেছে। যে তার ভালো খবর দিতে পারবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। ঐ দিন রাত পর্যন্ত কোনই খবর জানা যায় নি। রাতে ডুবুরীরা ফিরে এসে টহলদার প্রধানকে জানায় কাউকে নদীতে পাওয়া যায়নি। সবাই সেভাবেই অপেক্ষা করতে থাকে। হয়ত কেউ তার ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচানোর খবর নিয়ে আসবে। পরদিন শহরের বাইরে থেকে একজন বাগদাদ শহরে প্রবেশ করে খবর দেয় যে, গত রাতে দজলা নদী থেকে একটা শব্দ শুনা গেছে। কেউ একজন বলছিল, এক লোক পানিতে আছে কিন্তু ভয়ে কেউ তার কাছে যায়নি। অনুসন্ধানকারীরা এই খরব ওয়াচ টাওয়ারের প্রধানকে দেয়। যেহেতু শহরের বাইরে থেকে আর কোন খবর আসেনি তাই খলীফা বলেন, ডুবুরীরা দজলায় গিয়ে ফাত্হীর জীবিত অথবা মৃত খবর না নিয়ে যেন ফিরে না আসে। আরেক বার ডুবুরীরা নদীতে গেল। দিনে অনুসন্ধান করত ও রাতে স্থগিত রাখত।

এভাবে সাত দিন ও রাত খোঁজার পর নদীর পাড় ভাঙ্গা গহবরের কিনারে তাকে জীবিত খুঁজে পাওয়া যায়। তারা তাকে গ্রামের কাছাকাছি শুকনো জায়গায় নিয়ে আসে। দ্রুতগামী ঘোড়ায় উঠিয়ে খলীফার কাছে পৌঁছায়। ঘটনা বর্ণনা করে খলীফার কাছ থেকে পুরস্কার নেয়। খলীফা খুবই আনন্দিত হন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি দ্রুত আদেশ দেন, গোলামের জন্য খাবার নিয়ে এসো সে সাত দিন যাবৎ ক্ষুধার্ত। ফাত্হী বলল, খলীফার জয় হোক, আমি ভীত, নির্ঘুম, ক্লান্ত-শ্রান্ত কিন্তু ক্ষুধার্ত নই। মুতাওয়াক্কিল বললেন, হয়ত অনেক পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছ। অথবা ভয়ে অসংলগ্ন কথা বলছ। নতুবা এত দিনেও ক্ষুধার্ত হওনি এটা কিভাবে সম্ভব? ফাত্হী বলল, হ্যাঁ আমি নিজেই আশ্চর্য। কিন্তু যে সাত দিন ওখানে ছিলাম প্রতিদিন পানিতে একটি থালা ভেসে আসতে দেখতাম। যেখানে ১০টি রুটি ছিল, আর আমি যেখানে ছিলাম সেখানে পানির চাপ থালাটিকে নদীর কিনারে নিয়ে আসত। আমার যতগুলো ইচ্ছা রুটি নিয়ে খেতাম। আজকেও ডুবুরী পৌঁছার আগে রুটি খেয়েছিলাম। খলীফা বললেন আশ্চর্য কথা শুনছি। প্রতিদিন এক থালা রুটি দজলায় কি করত আর কোথা থেকে আসত? ফাত্হী বলল, জানি না কিন্তু ঘটনা সঠিক। থালাটি কাঠের ছিল এবং প্রতিদিন আসত। রুটিগুলোর উপর একজনের নাম লিখা ছিল। যদি আমার ভুল না হয় তবে লেখা ছিল মুহাম্মাদ বিন হাসান, মুচি। খলীফা বললেন, আশ্চর্য তো! এই মুহাম্মাদ বিন হাসান কে হবে এবং কেন এক থালা রুটি পানিতে ফেলে? অবশ্যই এই ঘটনার সত্যাসত্য জানাতে হবে। ঘোষকদের খবর দাও।

খলীফার মন্ত্রী বলল, তোমরা ঘোষণা কর, খলীফা মুহাম্মাদ বিন হাসান মুচিকে তলব করেছেন। যেই হোক যেন ভয় না পায়। খলীফা তার কোন ক্ষতি করবেন না। অন্য একদিন এক মুচি মুতাওয়াক্কিলের দরবারে এসে বলে, আমি খলীফার কাছে যেতে চাই। প্রহরীরা বলে, কী দরকার? বলে, মুহাম্মাদ বিন হাসান মুচিকে স্বয়ং খলীফা ডেকেছেন আর আমি মুহাম্মাদ বিন হাসান। তাকে খলীফার কাছে পাঠানো হয়। খলীফাকে সালাম দিয়ে বলে, আমি সেই মুচি যাকে হাযির হ’তে বলা হয়েছে। খলীফা জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি প্রতিদিন এক থালা রুটি দজলায় ভাসিয়ে দাও? উত্তর দেয়, জ্বী হ্যাঁ। খলীফা জিজ্ঞাসা করে তাতে কি চিহ্ন আছে? বলে, আমার নিজের নাম সেই রুটির মধ্যে লিখেছি। খলীফা বলেন, চিহ্ন ঠিক আছে। কতদিন যাবৎ পানিতে রুটি ভাসাও? সে ১ বছরের কথা বলল। এ কাজের কারণ কী? বলল, আমি শুনেছিলাম যে, বলা হয়- ভাল কাজ করে পানিতে ফেলে দাও, তোমার ভাল কাজের ফলাফল তোমার কাছে ফিরে আসবে। আমি জানতে চেয়েছিলাম ভাল কাজের ফলাফল কিভাবে আমার কাছে ফিরে আসবে। ভাসিয়ে দিলে তো সেগুলো দজলার পানিতে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু ফিরে তো আসছে না। আমি জানতাম যে, যদি কারও উপকার করি আর সেটার যদি প্রমাণ থাকে এবং ঐ ব্যক্তি যদি আমাকে চিনে থাকে তা’হলে সে ভাল কাজের ফলাফল আমার কাছে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু জানতে চাচ্ছিলাম কারো অগোচরে ভাল কাজ করলে ও কাউকে না চিনেই উপকার করলে কোন ব্যক্তির কাছে তার ফলাফল কিভাবে পৌঁছাবে। যদি অপরাধ করে থাকি তাহলে আশা করি খলীফা আমাকে ক্ষমা করবেন। খলীফা বলল, অপরাধ করনি বরং ছওয়াব অর্জন করেছ। তোমার শোনা কথাও সঠিক। আমরা জানি তোমার রুটিগুলো এক ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণ করেছে। তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে।.....আল্লাহ জানেন। খলীফা আদেশ দিলেন বাগদাদ শহরের বাইরে পাঁচ খন্ড জমি ও গ্রাম সীলমোহর দিয়ে উপহার হিসাবে মুচিকে দেওয়া হোক। মুহাম্মাদ বিন হাসান মুচি জমি পেয়ে সম্পদশালী হয়ে যায়। গ্রামের চতুর্পাশে অনেক ভাল কাজ করে। জমিগুলোতে চাষাবাদ করে। এই পুরস্কারের বদলৌতে নিজের দোকানে একজন কর্মচারীও রাখে।

[গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত। ]

শিক্ষা : গল্পটিতে চমৎকার কিছু শিক্ষণীয় বিষয় নিহিত রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অল্প শিখেই অনেক শিখে ফেলেছি এমন আত্মম্ভরিতা করা অনুচিত। যেকোন প্রশিক্ষণ সুসম্পন্ন না করা পর্যন্ত তা প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। দ্বিতীয়ত, ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। তৃতীয়ত, আল্লাহ প্রতিটি মানুষের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ রিয্ক বরাদ্দ রেখেছেন। বরাদ্দকৃত রিয্ক প্রত্যেকের কাছে নির্ধারিত জায়গায় অবশ্যই পৌঁছাবে। তাই সকলকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, নির্ধারিত রিয্ক ভক্ষণ না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তির মৃত্যু হবে না। আর সর্বশেষ শিক্ষণীয় বিষয় হল, যেকোন মানুষের উপকার করলে তার প্রতিদান আল্লাহ যেকোন মাধ্যমে পৃথিবীতে দিবেন অথবা আমলনামায় যুক্ত করে পরকালীন মহা সংকটের সময় উপহার দিবেন। তাই মানুষের কাছে প্রতিদান পাওয়ার আশা না করে সাধ্যমত পরিচিত কিংবা অপরিচিত সকলের উপকার করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব হওয়া উচিত।

[অনুবাদক : এম.এ (অধ্যায়নরত), ফারসী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।] 



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও