কিসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আমরা!

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1269 বার পঠিত

বলা হয়ে থাকে যে, লাইফ ইজ এ রেস- জীবন হ’ল এক প্রতিযোগিতার নাম। হ্যাঁ, প্রতিযোগিতাই বটে। আমাদের নিত্যকার পথচলা, আমাদের দৈনন্দিন চিন্তাধারা, আমাদের জীবনের লক্ষ্য, কর্মপন্থা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবকিছুর মধ্যেই এই প্রতিযোগিতার উপস্থিতি প্রবলভাবে বিদ্যমান। বিদ্যালয় পড়ুয়া শিশু, খেলার মাঠের তরুণ, চাকরীর পরীক্ষায় অবতীর্ণ যুবক কিংবা বাসে ওঠার কিউতে দাঁড়িয়ে থাকা পেশাজীবী, টিসিবির পণ্য পেতে লাইনে দাঁড়ানো শ্রমজীবী-এমন কেউই নেই যিনি এই বিরামহীন প্রতিযোগিতার চক্র থেকে বাইরে আছেন। এমনকি এই প্রতিযোগিতাই মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। অন্যকে টপকে সামনে যাওয়া কিংবা নিজেকে পিছনে পড়তে না দেয়ার জোর মানসিকতাই প্রতিযোগিতা, যা প্রতিটি মানুষের ভেতরকার সহজাত প্রবণতা। এই চাওয়া ইতিবাচক হ’লে নিঃসন্দেহে তাতে দোষের কিছু নেই। বরং তা প্রশংসার যোগ্য এবং কাম্য। কিন্তু যে প্রতিযোগিতা মানুষকে নেতিবাচক পথে পরিচালিত করে, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যে প্রতিযোগিতা ন্যায়-ইনছাফের দন্ডকে পদদলিত করে; যে প্রতিযোগিতা স্রেফ ভোগসর্বস্ব, আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থবাদী; যে প্রতিযোগিতা অর্থহীন ও অন্তঃসারশূন্য, সর্বোপরি যে প্রতিযোগিতা আখেরাতকে ভুলিয়ে দেয়- সে প্রতিযোগিতা নিঃসন্দেহে ব্যর্থ ও ধ্বংসাত্মক।

আজকের পুঁজিবাদী দুনিয়া এবং ভোগবাদী সমাজের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহ’লে বিলক্ষণ দেখা যাবে যে, অধিকাংশ মানুষই এক অন্তহীন নেতিবাচক প্রতিযোগিতার ঘেরাটোপে বাধা। সবাই যেন কোন এক অদৃশ্য নেশার ঘোরের মধ্যে ছুটে চলেছে- আরো চাই! আরো চাই! চাওয়ার যেন কোন শেষ নেই। হিসাবের খেরো খাতায় চাহিদাগুলো একটার পর একটা ধারাবাহিক যোগ হ’তেই থাকে। প্রলম্বিত হয় অন্ধের মত অবিশ্রান্ত ছুটে চলার পরিধি। হঠাৎ কখনও যদি পিছু ফিরে তাকানোর অবসর হয়, আধ্যাত্মিকতার পরশে অশান্ত মনটা সহসা প্রশান্ত হয়, তখন ক্ষণিকের জন্য হ’লেও মনে হয় কিসের পিছনে ছুটছি আমি? এসবের পিছনে ছুটে দিন শেষে লাভটা কী? কেন এসব করছি? কার জন্য করছি? লাভালাভের নিত্য হিসাবটা তখন কেমন যেন অর্থহীন, বিষাদময় মনে হয়। একসময় মনে হয়- জীবনটা বোধ হয় ষোল আনাই মিছে।

বস্ত্ততঃ ষোল আনা মিছের পিছনেই কিন্তু কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবনের অধিকাংশ সময়। যা কিছু করছি, তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে না হয়, তবে এ জীবন যে আদতেই ব্যর্থ জীবন। পশু-পাখির মতই এ জীবন মূল্যহীন। পরকালের খাতায় যে জীবনের মূল্য যোগ হয় না, সে জীবন তো আসলেই মিছে!

প্রিয় পাঠক! দুনিয়ার চাক্যচিক্য ও মোহে আমরা ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও প্রায়শঃই ভুলে যাই, আমরা আখেরাতের সন্তান, দুনিয়ার নই। আমাদের আসল বাসস্থান জান্নাত, দুনিয়া নয়। আমাদের প্রতিযোগিতার বিষয়বস্ত্ত দুনিয়া নয়, আখেরাত। দুনিয়ায় তো আমরা এসেছি মাত্র ক’দিনের মুসাফির হয়ে। সময় ফুরানো মাত্র ফিরে যেতে হবে আসল গন্তব্যে। একজন পর্যটক যেমন রঙিন দুনিয়ার মোহ ক্ষণিকের জন্য আস্বাদন করে ফেরৎ যায়, তার থেকে বিন্দুমাত্র ভিন্ন নয় আমাদের এই জীবন। আখেরাতের আয়নায় দুনিয়াটা দেখলে এই মহাসত্যটি অনুধাবন করা মোটেই জটিল কিছু নয়। কিন্তু আমরা যে গাফেল। চূড়ান্ত গাফেল। আর তাই তো নির্বোধ গাধার মত পরিশ্রম করি এমন কিছুর পিছনে, আখেরাতে যেসবের কোনই উপযোগিতা নেইএ আর দুনিয়াবী প্রাপ্তিও নগণ্য। অপরদিকে স্বল্প পরিশ্রমেই যেখানে অপেক্ষা করছে বিশাল প্রাপ্তি, চিরস্থায়ী স্বপ্নপূরণের হাতছানি, তার জন্য এক দন্ড সময় বের করতে গেলেও আসে হাযারো আলস্য আর অজুহাতের সমাহার।

অথচ আমরা নিজেকে কতই না বুদ্ধিমান ভাবি! নিজের আখের গোছানোর জন্য আমরা কতই না লোভাতুর! কিন্তু কখনও কি ভেবেছি আখের গোছানোর নামে আমরা আসলে কি গোছাচ্ছি? আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনার চালাকি আর প্রশান্তিতে ভরপুর চেহারার বিপরীতে কোন সে হতভাগ্য, নতমুখ চেহারা লুকিয়ে আছে? আফসোস শত আফসোস!

চূড়ান্ত বিচারের দিনে এই আফসোসে যেন পুড়তে না হয়, সেজন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আমাদেরকে অসংখ্যবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই জীবনের মূল প্রতিযোগিতা আসলে কিসের? এর বিষয়বস্ত্ত কী? দরদভরা ভাষায় তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা এবং এমন জান্নাত লাভের জন্য প্রতিযোগিতা কর, যার সীমানা আসমান এবং যমীনব্যাপী। কেবল মুত্তাকীদের জন্যই যা প্রস্ত্তত রাখা হয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা এগিয়ে চল তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের মত। আর তা প্রস্ত্তত রাখা হয়েছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের জন্য’ (হাদীদ ৫৭/২১)। ‘মুমিনদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন, তারা হ’ল এমন বান্দা যারা কল্যাণের কাজে সর্বদা প্রতিযোগিতা করে এবং তাতে তারা অগ্রগামী থাকে’ (মুমিনূন ২৩/৬১)। ‘অতএব (জান্নাতে নে‘মতলাভের জন্য) প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হোক’ (মুত্বাফফিফীন ৮৩/২৬)

কখনও ধমকের সুরে তিনি বলেন, ‘অতএব তোমরা সৎকাজের প্রতিযোগিতা কর, তোমরা যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে একত্র করবেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতাবান’ (বাক্বারাহ ২/১৪৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘অতএব সৎকর্মে তোমরা প্রতিযোগিতা কর, আল্লাহর দিকেই সকলের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করেছিলে, সে সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন’ (মায়েদাহ ৫/৪৮)

অতএব প্রিয় পাঠক! জীবন সত্যিই এক প্রতিযোগিতার নাম। তবে সত্যিকারের প্রতিযোগী তারাই যারা আখেরাতকে চিনেছে। লাভবান প্রতিযোগী তারাই যারা আখেরাতের জন্য প্রতিযোগিতা করে। অতএব আসুন! আমরা আমাদের প্রতিযোগিতার বিষয়বস্ত্তকে পরিবর্তন করে ফেলি। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, পদ-পদবী, গাড়ি-বাড়ির ধোঁকায় দুনিয়াবী প্রতিযোগিতায় নিজেকে বিলীন করে না দেই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জেনে রেখো যে, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পরস্পর গর্ব করা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্যের লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছুই নয়’ (হাদীদ ৫৭/২০)। সুতরাং জেনেশুনে এসব জিনিসকে প্রতিযোগিতার বিষয়বস্ত্ত বানানো নিরেট বোকামী ছাড়া কিছুই নয়। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, ‘তুমি যখন কাউকে দেখবে দুনিয়াবী দিক থেকে তোমার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন তার সাথে আখেরাতের বিষয়ে প্রতিযোগিতা কর’ (ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৬৩৫১)

সুতরাং আমরা প্রতিযোগিতা করব। তবে তা যেন নির্বোধের মত দুনিয়ামুখী না হয়ে পরকালীন কল্যাণই একমাত্র লক্ষ্য হয়। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজও যদি পরকালীন মুক্তির জন্য হয়, তাতেই আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য নিহিত। আর এই প্রতিযোগিতাই আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দেবে আমাদের সেই চিরস্থায়ী সুখের ঠিকানা। আল্লাহ বলেন, ‘তারা সকলে সমান নয়। আহলে কিতাবদের মধ্যে একটি হক্বপন্থী দল আছে, তারা রাত্রিকালে ছালাতরত অবস্থায় আল্লাহর আয়াত পাঠ করে। তারা আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে এবং তারা সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে এবং তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে। তারাই সৎকর্মশীলদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত (আলে ইমরান ৩/ ১১৪)।    

আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকল ভাই ও বোনকে ভোগবাদী দুনিয়ার মোহ থেকে রক্ষা করুন এবং আখেরাতমুখী জীবন যাপনের মাধ্যমে পরকালের পথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার তাওফীক দান করুন।- আমীন!



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও