আমার পিতা মাওলানা ফযলুল করীম (রহঃ)

মুহাম্মাদ মুবাশশির ইসলাম 482 বার পঠিত

একটি উজ্বল নক্ষত্র নিভে গেছে, যেই নক্ষত্র আর কোনোদিন জ্বলবেনা। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন এই প্রত্যাশা রইল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কুল্লু নাফসিন যায়েকাতুল মাওত’ ‘প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’ (আলে ইমরান ২/১৮৫)। চির পরিচিত এই আয়াত যা হাযারবার শুনেছি ও পড়েছি। মারকাযের ইছলাহুল বায়ানে জোর গলায় বক্তব্য দিয়েছি। কিন্তু কখনো ভাবিনি এই আয়াতের মর্ম কী? মানুষের মৃত্যু যখন চলে আসে তখন আমাদের আর কিছু করার থাকে না। চোখের সামনে যখন আমাদের অতি আপনজনের রূহ দেহ ত্যাগ করে তখন এই আয়াতের মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। আমার অতি আপনজন আমার শ্রদ্ধাভাজন আববা আমার শিক্ষক উস্তাযুল আসাতিযা মাওলানা ফযলুল করীম (রহঃ) এই দুনিয়ার মিছে মায়া ত্যাগ করে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ২০২২ শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা ৪০ মিনিটে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন। নিম্মে তারই স্মৃতিচারণ তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

...হঠাৎ খুব শীতে আববা কেঁপে উঠলেন। দেখা গেল তার হাইপো হয়ে ডায়াবেটিস নীল হয়ে গেছে। দ্রুত মিষ্টি জাতীয় কোনো কিছু তার মুখে দেওয়া হ’ল। আস্তে আস্তে তার অবস্থা স্বাভাবিক হ’ল। আবার কখনো দেখা গেল পৃথিবীর সব গরম যেন তার গায়ে লাগছে। তার মানে প্রেশার হাই হয়ে গেছে। দ্রুত সব ফ্যান দাও কিংবা হাতপাখার ঝড় তোলো। ধীরে ধীরে আবার প্রেশার স্বাভাবিক হ’ল..। এরকম ঘটনা ছিল আমাদের বাসার নিত্যদিনের কাহিনী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে মুছীবতে ফেলেন’। হয়তো আল্লাহ আববার কল্যাণ চেয়েছেন। তাই তিনি তাঁকে এমনভাবে মুছীবতে ফেলতেন। এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেই।

মৃত্যুর কয়েকদিন আগের কিছু স্মৃতি :

২২শে জানুয়ারী’২২ ছিল তাঁর মারকাযে পদচারণার শেষ দিন। দীর্ঘ সাতাশ বছর যেই মারকাযে তিনি মুহাদ্দিছ হিসাবে ছিলেন, সেই মারকাযে তিনি শেষ ক্লাস করলেন। প্রাণভরে দেখলেন মারকাযকে। তাঁর শেষ ক্লাস ছিল তাফসীরুল কুরআন ৬ষ্ঠ (খ) শ্রেণীতে। ঐ দিন তিনি শেষবারের মত আমাদের হেদায়াতুন নাহু পড়ান। আমার মনে আছে, ক্লাসে আলোচনার বিষয় ছিল- ‘তা‘আরীফু হেদায়াতুন নাহু ওয়া মাউযুউহু ও গারযুহু’।

ঐ দিন থেকে ২৮শে জানুয়ারী পর্যন্ত তিনি সাধারণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড দুর্বলতায় ভুগতে থাকেন। এর ফলে মারকাযে ক্লাস করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠে। এসময় তিনি বাড়িতেই অবস্থান করেন। সবসময় কেমন যেন অস্থিরতা অনুভব করতেন। কিন্তু তার প্রকৃতি তিনি প্রকাশ করতে পারতেন না।

২৯-৩০শে জানুয়ারী তিনি চূড়ান্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর চলৎশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায় আমরা তাঁকে মেডিকেলে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করি। কিন্তু আববা ছিলেন একজন হাসপাতাল বিমুখ মানুষ। তাঁর মতে, আল্লাহই আমাকে সুস্থ করবেন। আল্লাহই সব ডাক্তারের বড় ডাক্তার। তাঁর অতিরিক্ত নিষেধের কারণে আমরা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাধাগ্রস্ত হই।

পরের দু’দিন পর্যন্ত তিনি খাদ্যগ্রহণশক্তিও হারিয়ে ফেলেন। শুধুই পানি আর লেক্সাস বিস্কুট খেতেন। তা-ও পরিমাণে খুব কম। ফলে আস্তে আস্তে তিনি খুব দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েন। স্থানীয় ডাক্তারের মাধ্যমে জন্ডিস ধরা পড়ে। তিনি প্রচন্ড রকম শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তার কথা অনেক অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা শুনে আমার বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ (শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) আববার চিকিৎসার জন্য ঢাকা হ’তে বাড়ি আসেন। অতঃপর তিনি আববাকে  মেডিকেলে নিয়ে যাবার জন্য আববার প্রিয় ছাত্র ইমরুল ক্বায়েস ভাইয়ের সাথে চূড়ান্ত পরামর্শ করেন। ইতিপূর্বেও আববাকে হসপিটালাইজড করার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

২রা ফেব্রুয়ারী আববাকে সকাল ৯টায় ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (নওদাপাড়া, আমচত্তর) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর চেস্ট এক্সরে করা হয়। এতে তাঁর ফুসফুস ৬০ শতাংশ ইনফেক্টেড হয়ে যাবার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণের পরামর্শে তাঁকে ঐ দিনই রাজশাহী মেডিকেলে (রামেক) স্থানান্তর করা হয়। ১৬ নং ওয়ার্ডের যরূরী ও ক্যাজুয়ালিটি বিভাগের ৯ নং বেডে তাকে ভর্তি করা হয়।

এরই কিছুদিন আগে হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাবেক ম্যানেজার জনাব আব্দুল বারীর মৃত্যু খুবই কষ্ট দেয় তাঁকে। আববাকে মেডিকেলে নেয়ার ক্ষেত্রে এবং সেবা করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাকে খুবই ব্যথিত করে, তা হ’ল আববাকে যখন এ্যাম্বুলেন্সে করে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয় সে দৃশ্যটি। বিশেষ করে ফ্লাটের তিন তলা থেকে নামানোর দৃশ্য ছিল আরও করুণ। আমার মতো এই অধমের কলম যা তুলে ধরতে ব্যর্থ। এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরের করুণ দৃশ্য আমার খুব মনে পড়ে। তার প্রতিটি ব্যাথাতুর নিঃশ্বাস আমার হৃদয় গহীনে আঘাত হানছিল। যতবারই তাকে আমি চোখ তুলে দেখতে গিয়েছি, ততবারই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। অতঃপর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে আববা পরপারের যাত্রীদের কাতারে চিরতরে শামিল হলেন।

আববাকে লাশবাহী গাড়িতে ভোর ৫ টা ১২ মিনিটে আনা হল বাসায়। আববার শান্ত হাসিমাখা মুখ...নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছেন। আববার কাছে খুব প্রিয় আর ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমি। শেষবার যখন তাকে জড়িয়ে ধরি তখন তিনি লাশ হয়ে লাশবাহী গাড়ির স্ট্রেচারে শুয়ে ছিলেন। তাঁর কোনো ঋণ ছিল না। কাফনের কাপড় ছিল তার নিজের টাকায় কেনা।

শুক্রবার আববার কাছে যখন গিয়েছিলাম তখন তিনি আমাকে অনুনয়-বিনুনয় করে বলেন, মুবাশি্শর! বেটা আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। আমি বলেছিলাম, আববা বৃষ্টি হচ্ছে, কাল সকালে আপনাকে নিয়ে যাব। কিন্তু আববার আর তর সইলো না। বাড়ি আসার জন্য তিনি যেন জীবন দিয়ে দেবেন। অবশেষে বাড়ি এলেন শনিবার সকালে। তবে লাশ হয়ে। পরবর্তীতে মা আমাকে বলেন, মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে আববা আমাকে শুধু ডাকছিলেন। এই কথাগুলি মনে হলে মনের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি ঝরে।

সেদিনের সেই বিয়োগব্যাথার পর হাযারো সান্ত্বনার বাণী কী আমার মতো এক অধমের দুঃখ দূর করতে পারে? সকলেই মুখস্থ সান্ত্বনার বাণী বিলিয়ে দিচ্ছে আমাকে। কিন্তু সেদিন কী কেউ আমার হৃদয় গহীনের হাহাকার দেখেছিল? দেখেনি। إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ ‘আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি’ (ইউসুফ ১২/৮৬)

মৃত্যুর আগেই আববার দু’টি স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার দ্বারা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তিনি দুনিয়া ছাড়তে যাচ্ছেন। যা আজও আমাকে ভাবায়....। তিনি বলেছিলেন-

১. আমি ফজর প্রাক্কালে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি শুয়ে আছি। আর মাওলানা বদীউযযামান উস্তায আমার কাছে খুব হাসি মুখে আসলেন। তার পরনে ছিল উত্তম পোষাক। তিনি এসেই আমাকে মুচকি হাসি দিয়ে নিজের চাদরের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন। আমি সেভাবেই থাকলাম। তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেন, হয়তো আমি আমার প্রিয় উস্তাযের কাছে চলে যাব। তার ব্যাখ্যা সঠিক হল। তিনি চলে গেলেন।

২. তাঁর অন্য স্বপ্নটি হ’ল তিনি বুখারী পড়াতে পড়াতে অন্ধ হয়ে গেছেন। ছাত্রদের আগ্রহের ফলে তিনি বুখারীর কিতাব নেন। ব্যাখা হলো, অন্ধত্ব হ‘ল দুনিয়া থেকে বিদায়ের আলামত। আর তিনি সত্যই তাঁর রুটিনে বুখারীর ক্লাস নিয়েই মারা গেলেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নছীব করুন। আমীন!

শেষ গোসল :

তাঁর অছীয়ত মোতাবেক তাঁকে গোসল দেন মারকাযের সুপরিচিত মুযাম্মিল চাচা। তাঁর কথা ছিল আমার গোসল যেন মুযাম্মিল ভাই ছাড়া কেউ না দেয়। বরই-এর পাতা ছেড়ার সময় পড়ছিলাম চিরপরিচিত সেই আয়াত ....ফামান যুহযীহা আনিন্নার ওয়া উদখিলাল জান্নাতা ফাকাদ ফাযা। আল্লাহ আববাকে জান্নাতবাসী করুন। আমীন! গোসলের পর তাঁর চেহারা দিয়ে একটা আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তাঁর মুখ ছিল হাসিমাখা। কপোল জোড়া মুক্তার ন্যায় চকচক করছিলো।

আববার সাথে শেষ মিলন :

গোসলের পর হতেই মাঝে মধ্যে আমি আববাকে কয়েকবার চুমু দিই। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই আর বাবার মর্ম শেষবারের মত বোঝার চেষ্টা করি। জানাযার পরে পরে যখন আববার মুখ চিরদিনের জন্য বেঁধে দিবে ঠিক তখন আমি আববার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা চুমো দেই তাঁর কপালে। তিনি যেন বললেন, বেটা বড় হ! মানুষের মতো মানুষ হ!! মুখ যখন বেধে দেয়া হয় তখন একজন বাবাহারা সন্তানের মর্মবেদনা ও বুকফাটা হাহাকার অন্তরকে যেন ছিড়ে ফেলল! যেই বাবাকে কাল বুঝ দিলাম যে আপনাকে কাল বাড়ি নিয়ে যাব, সেই বাবা এখন লাশ। আহ! মানুষ এত সহজে মারা যায়।

জানাযা ছালাত :

জানাযার ছালাত হ’ল তাঁর প্রাণের কর্মস্থল আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীতে। ইমামতি করলেন মুহতারাম আমীরে জামাআত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার। বহু ছাত্র ও শুভাখাঙ্খী জানাযায় উপস্থিত হলেন। কবর দেয়ার জন্য রাজশাহীর বায়া, ভোলাবাড়ি কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হ’ল। অতঃপর যখন কবরে নামানো হবে, তখন দেখি আববার জন্য বাঁশ সহ সব প্রস্ত্তত। আমি নিতান্ত ক্লান্ত দেহ নিয়ে শেষবারের মতো আববার দেহটা দেখছি। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আববার কবরের আলো। মাটি দিচ্ছে সবাই। লোক শেষ হ’ল না মাটি দেয়া শেষ হয়ে গেল। সাঙ্গ হ’ল দুনিয়াবী মায়ার জীবন।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী :

নাম ও জন্ম :

মাওলানা মুহাম্মাদ ফযলুল করীম (রহঃ)। তিনি ১৯৬৫ সনের ৩রা মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেলার ভোলাহাট থানাধীন চামা মুশরীভূজা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি মুহাম্মাদ আবুল কাশেম সর্দার। মা ছিলেন সুগৃহিনী মোছাঃ কুবেরা বেগম।

শিক্ষার হাতেখড়ি :

বাবার কাছেই তাঁর শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। উনার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল একটু বিস্ময়কর। তাঁর বাবা তাঁকে গাছের নীচে মাটিতে লেখা শেখাতেন। আর শাস্তিও ছিল অভিনব। না লিখতে পারলে হাত ধরে মাটির সাথে চেপে দেয়া হতো। ধুলো ছিল তার খাতা আর আংগুল ছিল কলম। তিনি লিখতেন... ক খ গ... এ বি সি...আলিফ বা তা ....। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই তিনি ভাইদের সাথে স্কুলে গেছেন। পূর্বের কথা স্মৃতিচারণ করার সময় একদিন তিনি বলেন, তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত তার মনে আছে। ধুলোতে আংগুল ঘষে লিখলেও তার লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। তাঁর শিক্ষকরা মজা করে বলতেন যে, ফযলুল করীম! রেজাল্ট নিতে হ’লে আঢ়ি বা ধামা (ধান রাখার পাত্র বিশেষ) নিয়ে আস। তার নাম্বারের পরিধি ছিল এত বেশী। কর্মজীবনে হাতে লিখে প্রশ্নপত্র তৈরী করতেন। আর তার মত হাতের লেখা ভালো করার জন্য অনেক ছাত্র প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ করত।

শিক্ষাজীবন :

১৯৭৭ সালে তিনি মুশরীভূজা প্রথমিক বিদ্যালয় হতে ৫ম শ্রেণী কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় তিনি থানায় প্রথম হ’ন। এর পর বিরেশ^রপুর ইসলামিয়া সালাফিয়াহ মাদ্রাসায় ৩-৪ বছর প্রাথমিক ইসলাম শিক্ষা, আরবী, কুরআন ও নাহু-ছরফের সামান্য কিছু পড়েন।

মাদ্রাসা থেকে কখনো যদি তিনি বাড়ি আসতেন তবে তাঁর বাবা তাকে নাহু-ছরফের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। তিনি উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দাদা তাঁকে সঠিকটা শিখিয়ে দিতেন। আরবী গ্রামার শেখার ক্ষেত্রে তাঁর বাবার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখাপড়া খুব ভালবাসতেন। এর প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ, যা আমরণ তাঁর মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এজন্যই তিনি ছিলেন পিতার প্রিয়পাত্র। তিনি বলতেন, আমার ‘মুলবী সাহেব’ (আদর করে ডাকতেন) তো কৃষিকাজ করতে পারবেন না। আল্লাহ যেন তাকে উত্তম কিছু করান।

অতঃপর তিনি আলাদিপুর দারুল হুদা সালাফিয়াহ মাদ্রাসায় ৬-৭ বছর প্রচুর সংগ্রাম করে পড়াশুনা করেন। আরবী গ্রামারের শেষটা তাঁর এখানেই। তিনি এখানে হেদায়াতুন নাহু, কাফিয়া, শরহে মোল্লা জামী, শরহে বেকায়া, তালখীসুল মিফতাহ, জালালাইন, তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ সহ আরও অনেক কিতাব অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি মাওলানা শামসুদ্দীন, মাওলানা আব্দুল মান্নান আনছারী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব হাটহাজারী, মাওলানা আব্দুর রহীম কামাশপুর, মাওলানা আব্দুন নূর ইছলাহী ও মাওলানা বদীউযযামানের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। এছাড়াও তৎকালীন সময়ের বড় বড় মুহাদ্দিছগণের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। যা অজানাই রয়ে গেছে।

মাওলানা বদীউযযামান (রহঃ) ও আব্দুল মান্নান আনছারী (রহঃ) ছিলেন তাঁর দুই প্রিয় শিক্ষক। এমনকি মাওলানা আব্দুল মান্নান আনছারী দুইবার স্বীয় ছাত্রের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। যখন তিনি আলাদিপুর মাদ্রাসায় পড়েন ঠিক সেই সময়ে আশেপাশের কয়েক মাদ্রাসার মধ্যে তিনি ছিলেন সেরা। সবাই তাকে চিনত।

এছাড়া তিনি হাটহাজারীতেও পড়তে যান। কিন্তু অর্থাভাবে সেখানে তিনি পড়তে পারেন নি। এই সেই বিখ্যাত ছাত্র যার পরনে থাকত অসংখ্য তালি দেয়া একটি পাঞ্জাবী। যার পড়ার জন্য ছিল না বই। বন্ধু কিংবা সহপাঠিদের পড়া বলে দিয়ে তাদের বই ধার করে পড়তেন। এই বিখ্যাত ছাত্রই ছিলেন তিনি।

তিনি ১৯৯০ সালে বিনোদনগর দাখিল মাদ্রাসা হ‘তে দাখিল পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৯২ সালে গোপালপুর হারুন অর রশীদ সিনিয়র মাদ্রাসা হ’তে আলিম পাশ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি মাদ্রাসা আলিয়া ঢাকা হ’তে ফাযিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হ’ন। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য তিনি ঢাকার কবি কাজী নজরুল কলেজে ভর্তি হ’ন। কিন্তু অর্থাভাবে তিনি সেখানেও পড়তে পারেন নি। ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে আমার দাদা মৃত্যুবরণ করেন।

অতঃপর ১৯৯৭ সালে রাজশাহী কলেজ, কলা অনুষদ থেকে বিএ পরীক্ষায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঐ একই কলেজ হতে ১৯৯৯ সালে তিনি ইসলাম শিক্ষা বিভাগ হ’তে হাদীছ বিষয়ে ১ম বিভাগে ১ম হয়ে উত্তীর্ণ হন।

এছাড়াও রাজশাহী দারুস সালাম আলিয়া মাদ্রাসা হ’তে ১৯৯৯ সালেই হাদীছ বিভাগ হ’তে কামিল পরীক্ষা দেন।

তাঁর পুরনো ফাইল ও বইতে বিভিন্ন পুরাতন ও বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মিলে। যেগুলোর প্রতিটিতে তার ভর্তি হওয়া ছিল। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর সেখানে পড়া হয়নি। এভাবেই তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ হয়। তবে অন্যান্য জ্ঞান অন্বেষণে ছিল তাঁর প্রচুর আগ্রহ। যার ফলে বাহিরের কিতাবও পড়তেন।

কর্মজীবন :

আলাদিপুর মাদ্রাসায় পড়ালেখা করাকালীন সময়েই অর্থাভাবে তাকে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হ’তে হয়। প্রথমত তিনি নিজ এলাকার মুশরীভূজা আরাবিয়া ইসলামী ক্বওমী মাদ্রাসায় ৩ বছর শিক্ষকতা করেন। অতঃপর জামে বারোটুঙ্গি মসজিদে ৬ বছর ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। দারুল হাদীছ মাদ্রাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনি ৬ থেকে ৭ বছর শিক্ষকতা করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মসজিদে দায়িত্বরত থাকতেন। তাঁর মোট কর্মজীবন ছিল প্রায় ৪১ বছর।

তাঁর জীবনের সর্বশেষ ও স্থায়ী কর্মস্থল ছিল উত্তরাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশে’-এর অধীনে পরিচালিত নওদাপাড়াস্থ কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’। এখানে তিনি ১লা মে ১৯৯৫ সালে মুহাদ্দিছ হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ (২৭ বছর) আমৃত্যু তিনি উক্ত পদে বহাল থাকেন। মারকাযকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। বিভিন্ন সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ বেতনের চাকুরীর অফার তিনি না্কচ করেন। বিভিন্ন সময় তাকে অনেক ব্যক্তি ও মাদ্রাসা উচ্চ বেতনে উচ্চ পদে চাকুরীর আহবান করেন। কিন্তু তার কথাটি আজও আমার কানে বাজে...‘মারকাযের একটা ইট থাকা পর্যন্ত ফযলুল করীম কোথাও যাবেনা’। সত্যই তিনি কথা রেখেছেন। কোথাও না গিয়েই আমাদের ছেড়ে গেলেন চিরদিনের জন্য।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু ছাত্র :

দেশে-বিদেশে তার অসংখ্য ছাত্র কর্মরত ও অধ্যায়নরত। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক। যার তালিকা পেশ করতে বহু কালি খরচ হবে। তিনি ৪১ বছরের কর্মজীবনে যত ছাত্র তৈরী করেছেন তা অকল্পনীয়। তিনি জানাযার ছালাতে ছাত্র, শিক্ষক সকলের প্রাণখোলা দো‘আ ও ভালবাসা পেয়েছেন। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য ছাত্র- ড. শিহাবুদ্দীন, ড. নূরুল ইসলাম, ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর, ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব, ড. মুখতার আযহার, ড. আব্দুল হালীম, হাফেয আব্দুল মতীন মাদানী, শরীফুল ইসলাম মাদানী, ড. আব্দুল্লাহিল কাফী, মুকাররম বিন মুহসিন, আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রায্যাক প্রমুখ।

এছাড়াও তাঁর অনেক ছাত্র বর্তমানে মদীনাসহ আরও বিভিন্ন স্থানে অধ্যায়নরত এবং অনেকে মারকায, আন্দোলন, যুবসংঘ সোণামণি সহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন।

একজন শিক্ষক হিসাবে যেরকম পেয়েছি :

একজন শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অতুলনীয় ব্যক্তি। কোনো কোনো সময় তিনি যদিও আমাদের সাথে কড়া ব্যবহার করতেন তবু তিনি তা আমাদের শিক্ষক হিসাবে আমাদেরকে শিক্ষা দিতেন।

নাহু ছরফের অর্ধশতাধিক কিতাব তাঁর মুখস্থ ও নখদর্পনে ছিল। নাহু বা ছরফ বিষয়ক কোনো জটিল সমস্যা হলে আববার নিকট সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিছু তা‘লীল প্রসিদ্ধ হলেও বিশুদ্ধ নয় তিনি তা প্রমাণ করেন। যেমন মীযান-এর তালীল। একবার তিনি মজা করে বলেছিলেন, যে ছাত্র ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম শ্রেণীর নাহু ছরফ বিষয়ক কৃত সকল গুনাহ মাফ করতে চায়, সে যেন হেদায়াতুন নাহু মুখস্থ করে নেয়। তাঁর পড়ানোর দক্ষতা ছিল অনন্য। উনি এমন একজন শিক্ষক ছিলেন, যাকে তিনি যত বেশী শাসন করতেন, সে ছাত্র তত বেশী তাঁর প্রিয় ছাত্রে পরিণত হত। ছাত্রদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও আন্তরিকতা ছিল সুগভীর। মজার বিষয় হ’ল মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্রই ভাবতো যে, উস্তাদযী বোধহয় তাকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। সুবহানাল্লাহ। 

শেষ কথা :

পিতার মর্ম অনেক। আমি ভাবি আর কেউ সেই চিরপরিচিত কন্ঠে বলবেনা, বাবা এক গ্লাস পানি দে। কেউ মুবাশি^রুল ইসলামের কবিতা আত-তাহরীকের কবিতা কলাম থেকে পড়বেনা। আন্তরিক দো’আ দিবেনা। দেখাবে না স্বপ্ন। উপদেশ দিবেনা একজন বড় মানুষ হবার। রাতের পর রাত আববার জীবনী লিখতে গিয়ে অশ্রুতে ভিজেছে খাতা আর ফাইল। আর কাকে আমি বাবা বলব। আল্লাহ তুমি আমাদের সম্মান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখ। আরও না বলা কথাগুলি থাকল হৃদয় গহীনে।

আল্লাহ তুমি তাকে জান্নাতবাসী কর। তাঁর সব গুনাহ ক্ষমা কর। তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নছীব কর! তাঁর কবরকে আলোকিত কর। আর এই অধমকে জান্নাতে তাঁর সাথে মিলিত কর-আমীন!!

মুহাম্মাদ মুবাশশির ইসলাম

লেখক : মরহুমের ছোট ছেলে ও শিক্ষার্থী, আল মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়া, রাজশাহী ।



আরও