প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন যুগান্তকারী সেই মানুষগুলো
এস.এম. রিয়াজুল ইসলাম
ঘ. লোকের দোষ-ক্রটি তালাশকারী :
মানুষের দোষ-ক্রটি তালাশ করা গর্হিত কাজ। সর্বদা অন্যের নয়, নিজের দোষ-ক্রুটি তালাশ করা উচিৎ। রাসূল (ছাঃ) মানুষের দোষ ও ছিদ্রান্বেষণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি মানুষকে স্ব-স্ব দোষত্রুটি সংশোধনে আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহর কাছে যেসব কথাবার্তা-ধ্যানধারণার মূল্য নেই তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সর্বোপরি মুসলিম ভাইয়ের ছিদ্রান্বেষণকারীর অন্তরে ঈমান থাকে না। আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلاَ تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِى بَيْتِهِ ‘ওহে যারা মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে ঈমান এনেছ, অথচ এখনো অন্তঃকরণে ঈমান পৌঁছেনি! তোমরা মুসলিমদের নিন্দা কর না, তাদের ছিদ্রান্বেষণ করো না। কেননা যে ব্যক্তি অপরের দোষ খোঁজে আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আর আল্লাহ যার দোষ তালাশ করেন, তাকে তার নিজস্ব বাসগৃহেই অপদস্ত করেন’।[1]
মুমিন ব্যক্তির দোষ-ক্রটি তালাশ করা অন্যায় ও পাপ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (আহযাব ৩৩/৫৮)।
সুতরাং অন্যের নয়, নিজের দোষ-ক্রটি তালাশ করে তা অতি সত্বর সংশোধন করা উচিৎ। এতে নিজের আমল-আখলাকে পূর্ণতা পায় এবং আত্মতৃপ্তি থাকে সদাসর্বদা। আবু হাত্বেব ইবনু হিববান আল-বাস্তী (রহঃ) বলেন, ‘জ্ঞানীদের উপর আবশ্যক হ’ল অপর মানুষের অনাচার থেকে নিজেকে পূর্ণভাবে মুক্ত রাখা, নিজের দোষ-ক্রটি সংশোধনার্থে সর্বদা নিমগ্ন থাকা। যে ব্যক্তি অপরেরটা ত্যাগ করে নিজের ভুলক্রটি সংশোধনে সদা ব্যস্ত থাকে, তার দেহ-মন শান্তিতে থাকে। আর যে অন্য মানুষ সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে, তার অন্তর মরে যায়, আত্মিক অশান্তি বেড়ে যায় এবং তার অন্যায় কর্মও বৃদ্ধি পায়’।[2]
৩. অধিকাংশ মানুষ শিরককারী :
শিরক হ’ল শরীক করা। শিরক একটি চূড়ান্ত কবীরা গুনাহ। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করাকে শিরক বলা হয়। সেটা একক স্রষ্টার মর্যাদার সাথে হোক, তাঁর গুণাবলী ও তাঁর ইবাদত সমূহের সাথে হোক। এমনটি মনে করা যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যরাও আহারদাতা, জীবন ও মৃত্যুর মালিক, ধনদৌলত ও সন্তানাদি প্রদানকারী কিংবা উপকার-অপকারের ক্ষমতাধারী। ইবাদতগুলোর মধ্য হতে কোন ইবাদত অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা। যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, দো‘আ, মানত, কুরবানী, ভালবাসা, ভয়ভীতি ইত্যাদি অন্য কারো জন্য করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এই গুনাহকারীর ওপর আল্লাহ তা‘আলা চরম ক্রোধান্বিত হোন। এদের জন্য চূড়ান্ত ফয়ছালা হ’ল চিরস্থায়ী জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তবে (ইবাদাতে) শিরক করা অবস্থায়’ (ইউসুফ ১২/১০৬)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, যারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, জীবন এবং মৃত্যুদাতা বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্যকে শরীক করে, উক্ত আয়াতে তাদেরকে মুশরিক বলা হয়েছে (ইবনু কাছীর উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ; বুখারী, ‘তাওহীদ’ অধ্যায় ৪০ অনুচ্ছেদ)। আবু জাহল ও আবু লাহাবের ন্যায় আজকের যুগেও অধিকাংশ মানুষ আল্লাহকে একক সৃষ্টিকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করলেও ইবাদতের ক্ষেত্রে তারা শিরক করে থাকে। উক্ত আয়াতে তাদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায় অনুরূপ আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মধ্যে কোন ধরনের বিকৃতি বা অস্বীকৃতির মাধ্যমে শিরক করা হয়। সমাজে বহু শিরকী কাজ চালু রয়েছে। যেমন মূর্তিপূজা, পীরপূজা, মাযার ও কবরপূজা, মাযারে শিরনী দেয়া, কবরবাসীর কাছে কিছু চাওয়া, কবরে চাদর চড়ানো, ফুল দেয়া, মানত করা, তাবীয লটকানো, গায়রুল্লাহর নামে যবেহ করা ও কসম করা ইত্যাদি শিরকী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর এসব পূজা-অর্চনাকে শিরকে আকবার বলে, যা শয়তানী কাজ এবং কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদী, শুভাশুভ নির্ণয়ের তীর, এসবই গর্হিত বিষয় ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে দূরে থাক। যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পারো’ (মায়েদাহ ৫/৯০)।
এছাড়াও মানুষ ইবাদতের মাধ্যমে শিরক করে থাকে। প্রাক-ইসলামী যুগে মুশরিকরা কা‘বা তাওয়াফের সময় তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে শিরক করত। আর এটাই ইবাদত ও ঈমানের সাথে শিরকের সংমিশ্রণ করেছিল। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, মুশরিকরা বলত, لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، قَالَ: فَيَقُولُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَيْلَكُمْ، قَدْ قَدْ» فَيَقُولُونَ: إِلَّا شَرِيكًا هُوَ لَكَ، تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ، يَقُولُونَ هَذَا وَهُمْ يَطُوفُونَ بِالْبَيْتِ ‘লাববায়কা লা- শারীকা লাকা’। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, ‘তোমাদের ক্ষতি হোক, ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও (সামনে আর বলে না)। তারা এর সাথে আরও বলত, ‘কিন্তু হে আল্লাহ! তোমার আরও একজন শরীক আছে- তুমিই যার মালিক এবং সে যার মালিক’। তারা এ কথা বলত আর বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করত।[3] কারণ এর পরের অংশটুকু শিরক। তারা ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে ফেলেছিল।
রিয়া প্রদর্শন বা লোক দেখানো ইবাদত করাকে শিরকে আছগার বলা হয়। আর আল্লাহ বিচার দিবসে এমন ব্যক্তিদেরকে তাড়িয়ে দিবেন। মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً. ‘আমি তোমাদের জন্য যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হ’ল শিরকে আছগর (ছোট শিরক)। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেসা করলেন ‘হে আল্লাহর রাসূল ছোট শিরক কি?’ তিনি জওয়াবে বললেন ‘রিয়া’ লোক দেখানো বা যাহির করা। কারণ নিশ্চয়ই শেষ বিচারের দিনে মানুষ তার পুরস্কার গ্রহণের সময় আল্লাহ বলবেন, ‘বস্ত্তজগতে যাদের কাছে তুমি নিজেকে যাহির করেছিলে তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের নিকট হ’তে কোন পুরস্কার পাও কি না’।[4] অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا، ‘অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)।
এই রিয়া প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শিরকও বলা হয়। এই শিরক দাজ্জালের ফেৎনার চেয়েও ভয়াবহ। ইবাদতে, ছালাতে, ছিয়ামে, তেলাওয়াতে, বক্তৃতার মাঠে সর্বত্র লৌকিকতায় ভরপুর। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা দিলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ؟ قَالَ قُلْنَا بَلَى، فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর একটি বিষয় সম্পর্কে বলব না? আমরা বললাম, জী, বলুন। তিনি উত্তর দিলেন, সেটা হ’ল গুপ্ত শিরক। (অর্থাৎ) যখন কেউ ছালাত আদায় করতে উঠে ছালাত সুন্দর করার জন্য চেষ্টা করে এই ভেবে যে লোকেরা তার প্রতি চেয়ে আছে, সেটাই গুপ্ত শিরক’।[5] ইবনে আববাস (রাঃ) এই বাস্তবতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘চন্দ্রবিহীন রাত্রে একটা কালো পাথর বেয়ে উঠা একটা কালো পিঁপড়ার চেয়েও গোপন হ’ল গুপ্ত শিরক বা শিরকে আছগার’।[6]
বর্তমান সমাজে লৌকিকতায় ছড়াছড়ি। দান করছে এক প্যাকেট খাবার, কিন্তু ৫-১০ জন দাতার ছবি দেখানো হচ্ছে। মানুষ দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রেও রিয়া প্রদর্শন করে চলেছে। কী ছোট, কী বড় সকল বক্তাদের স্যোশাল মিডিয়ার লাইভে এসে বাহাদুরী। শুধু তাই নয়, ইবাদতের ক্ষেত্রেও স্যোশাল মিডিয়াতে এসে পোস্ট করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। এসব দ্বীন প্রচারের নামে রিয়া প্রদর্শন মাত্র। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللَّهُ بِهِ ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমল করে আল্লাহ তা’আলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকেদেরকে জানিয়ে ও শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কোন নেক কাজ করে, আল্লাহ তা’আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদের মাঝে ফাঁস করে দিবেন।[7]
লৌকিকতা কয়লার দূর্গন্ধ ধোঁয়ার মত। ইবনু রজব হাম্বালী (৭৩৬-৭৯৫হি.) (রহঃ) বলেন,وَرَائِحَةُ الْرِيَاءِ كَدُخَانِ الْحِطَبِ، يَعِلُوْ إِلَى الْجَو ثُمَّ يَضْمِحَل وَتَبْقِى رَائحته الكَرِيْهَة ‘রিয়া বা লৌকিকতার ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল কয়লার ধোঁয়ার ন্যায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার দূর্গন্ধ কেবল অবশিষ্ট থাকে’।[8]
শিরকের মাধ্যমে জান্নাত হারাম হয়ে যায় এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হ’তে হয়। সুতরাং শিরক থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করবে তার উপর জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম হবে তার চূড়ান্ত ঠিকানা। আর সেদিন যালেমদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না’ (মায়েদা ৫/৭২)। আর মনে রাখতে হবে, জীবন বিপন্ন হ’লেও শিরক করা যাবে না। শিরকের পরিণতি ধ্বংস। শিরকের পাপের কোন ক্ষমা নেই। শিরক অতি সঙ্গোপনে আগমন করে। শিরক সমস্ত নেক আমলকে বিফল করে দেয়। শিরক মিশ্রিত ঈমান কখনোই ঈমান হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়। মুশরিকরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধ। অতএব সকল প্রকার শিরক থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
৪. অধিকাংশ লোক ফাসেক :
ফাসেক তাকে বলে, যে শরী‘আতের কিছু বিধি-বিধান উপেক্ষার মাধ্যমে ছোট বা বড় গুনাহ করে থাকে। অর্থাৎ ক্রটিপূর্ণ মুমিনগণ ‘ফাসেক’। কিন্তু তারা ‘কাফের’ বা ইসলাম থেকে খারিজ ও ‘মুরতাদ’ নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ. ‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে; আর যদি আহলে কিতাবরা বিশ্বাস স্থাপন করত তাহলে অবশ্যই তাদের জন্য মঙ্গল হত; তাদের মধ্যে কেহ কেহ মু’মিন এবং তাদের অধিকাংশই ফাসেক (আলে-ইমরান ৩/১১০)। অন্যত্র বলেন, قُلْ يَاأَهْلَ الْكِتَابِ هَلْ تَنْقِمُونَ مِنَّا إِلَّا أَنْ آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلُ وَأَنَّ أَكْثَرَكُمْ فَاسِقُونَ ‘বলো, হে কিতাবীরা, কেবল এ কারণে কি তোমরা আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো যে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং পূর্বে নাযিল হয়েছে তার প্রতি? আর নিশ্চয়ই তোমাদের অধিকাংশ ফাসেক’ (মায়েদা ৫/৫৯)। অন্যত্র বলেন, وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক (মায়েদা ৫/৪৭)।
আল্লাহর আইনে বিচার ফয়ছালা না করার কারণে গুণাহগার হলেও কেউ পুরোপুরি কাফের হয়ে যায় না। যেমন- সূদ-ঘুষ ও প্রবৃত্তির তাড়নায় বিচার-ফয়ছালা করে, তখন সে বিচারক যালিম বা ফাসিক হিসাবে বিবেচিত হবে। আবার কেউ মানুষের উপর যুলুম করার মানসে আল্লাহর আইন ব্যতীত বিচার করে, আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করার সুযোগ না থাকে এবং বিচারের অভাবে মানুষের হক নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে, তখন সে ফাসেক বলে বিবেচিত হবে। এগুলো বড় শিরক কিংবা কুফরীর পর্যায়ে পড়ে না। যারা এ কাজ করবে, তারা ছোট শিরক বা ছোট কুফরী করেছে বলে গণ্য হবে।[9]
একজন মুমিন ভাই অপর মুমিন ভাইকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং হত্যা করা কুফরী। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকী এবং তাকে হত্যা করা কুফরী’।[10]
সর্বদা মানুষের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করা উচিৎ। কিন্তু তার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা আবার দোষের নয়। তবে সাবধান! অহেতুক কোন মুসলিম ভাইকে ‘ফাসেক’ অথবা ‘কাফের’ বলে সম্বোধন করা উচিৎ হবে না।
আবূ যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তিনি এ কথা বলতে শুনেছেন যে, لاَ يَرْمِى رَجُلٌ رَجُلاً بِالْفُسُوقِ ، وَلاَ يَرْمِيهِ بِالْكُفْرِ ، إِلاَّ ارْتَدَّتْ عَلَيْهِ ، إِنْ لَمْ يَكُنْ صَاحِبُهُ كَذَلِكَ ‘যখন কোন মানুষ অন্য মানুষের প্রতি ‘ফাসেক’ অথবা ’কাফের’ বলে অপবাদ দেয়, তখন তা তার উপরেই বর্তায়; যদি তার প্রতিপক্ষ তা না হয়’।[11]
ফাসেক ব্যক্তির কথা যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। নতুবা মুসলিম সমাজের ক্ষতি সাধিত হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ ‘হে মুমিনগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহ’লে তোমরা সেটা যাচাই কর, যাতে অজ্ঞতাবশে তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধন না করে বস। অতঃপর নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হও’ (হুজুরাত ৪৯/৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,كَيْفَ وَإِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لَا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً يُرْضُونَكُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ وَأَكْثَرُهُمْ فَاسِقُونَ. ‘কীভাবে থাকবে (মুশরিকদের জন্য অঙ্গীকার)? অথচ তারা যদি তোমাদের উপর জয়ী হয়, তাহ’লে তারা তোমাদের আত্মীয়তা ও অঙ্গীকারের ব্যাপারে লক্ষ্য রাখে না। তারা তাদের মুখের (কথা) দ্বারা তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে, কিন্তু তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক’ (তাওবা ৯/৮)।
৫. অধিকাংশ ব্যক্তি ধারণা পোষণকারী :
মানুষ সম্পর্কে সুধারণা রাখা উত্তম কাজ এবং এটা কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। পক্ষান্তরে কুধারণা করা মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়ার মত কাজ এবং এটা মন্দের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। ধারণা বড় মিথ্যা ব্যাপার....।[12]
একজন মুমিন সম্পর্কে অপর মুমিনের ইতিবাচক মনোভাব রেখে তার উপর পূর্ণ সুধারণা রাখা উচিৎ। অন্যথায় নেতিবাচক ধারণা পোষণের মাধ্যমে শক্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-কলহের সূত্রপাত ঘটায়। আর এসবেরই মূল হ’ল নিছক ধারণা ও অনুমান। এই অন্যায় ধারণার কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই বিভ্রান্ত। কেননা অধিকাংশ মানুষ ধারণাবশে চলতে পসন্দ করে। অথচ এসব ধারণা তাদের কোন কাজে আসে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ ‘আর তাদের অধিকাংশ কেবল ধারণার অনুসরণ করে। নিশ্চয় সত্যের বিপরীতে ধারণা কোন কার্যকারিতা রাখে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে সে সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (ইউনুস ১০/৩৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ ‘তুমি যদি দুনিয়াবাসীর অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করবে। তারা নিছক ধারণা ও অনুমানেরই অনুসরণ করে, আর তারা ধারণা ও অনুমান ছাড়া কিছুই করছে না’ (আন‘আম ৬/১১৬)।
অধিকাংশ মানুষের চরিত্র হ’ল নিজেকে পরিশুদ্ধ মনে করে এবং মন্দ বা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে একে অপরের প্রতি মিথ্যারোপ করে ও মন্দ ধারণা পোষণ করে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা এসম্পর্কে নিষেধ করে বলেন, فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى ‘তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনিই সর্বাধিক অবগত কে বেশী পরহেযগার’ (নাজম ৫৩/৩২)।
মানুষ অন্যের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না বা খবর রাখে না। অন্যের কথা শুনা মাত্রই সে ব্যাপারে পজিটিভ ধারণা রাখা উচিৎ। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, وَلَا تَظُنَّنَّ بِكَلِمَةٍ خَرَجَتْ مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ شَرًّا وَأَنْتَ تَجِدُ لَهُ فِي الْخَيْرِ مَحْمَلًا ‘তোমার ভাইয়ের ভেতর থেকে যে কথা বের হয়েছে, তাকে তুমি খারাপ অর্থে নিবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা উত্তম অর্থে নেয়ার সুযোগ থাকবে’।[13]
অধিক ধারণা মন্দের প্রসূতি। ধারণাকারী ক্রমে ক্রমে ঈমান ও আমল থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلاَ يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে বেঁচে থাক, কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে ভালবাসে? বস্ত্ততঃ তোমরা একে ঘৃণাই কর। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তওবা কবুলকারী, কৃপাণিধান’ (হুজুরাত ৪৩/১২)।
অপর ভাইয়ের দোষ-ক্রটি খোঁজ করা যেমন অন্যায় ও পাপ, তেমনি ফেৎনা-ফাসাদ ও শক্রতা পোষণের অন্যতম মাধ্যম। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কারো প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করো না। কেননা মন্দ ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। একে অপরের দোষ-ক্রটি খুঁজবে না, একে অন্যের ব্যাপারে মন্দ কথায় কান দিও না এবং একে অপরের প্রতি শক্রতা পোষণ করো না; বরং ভাই ভাই হয়ে যাও’।[14]
মিথ্যা ধারণা মানুষের অন্তরকে সংকুচিত করে এবং সর্বদা চিন্তিত রাখে। তাছাড়া পার্থিব জীবনে মানসিক পীড়া ও অশান্তি নিয়ে দিন যাপন করে। আর মানসিক প্রশান্তি বৈষয়িক জীবনে সকল কিছুর চেয়ে উত্তম। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘মানসিক প্রশান্তিই সবচেয়ে বড় প্রশান্তি এবং মানসিক শাস্তিই সবচেয়ে বড় শাস্তি’।[15]
আমাদের উচিৎ সর্বদা অন্যের সম্পর্কে ভালো ধারণা অন্তরে পোষণ করা। এতে করে এক দিকে যেমন পাপমুক্ত এবং অপরদিকে অন্তরের প্রশান্তি অনুভব করা যায়। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) অসুস্থ হ’লে তার কতিপয় ভাই তাকে দেখতে এসে তাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনার দুর্বলতাকে শক্তিশালী করুন। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, আল্লাহ যদি আমার দুর্বলতাকে শক্তিশালীভাবে স্থায়িত্ব দেন, তবে তো আমার মৃত্যু হবে! তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি কল্যাণ ছাড়া কিছুই কামনা করিনি। তখন ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, আপনি যদি আমাকে গালিগালাজও করতেন, তবুও আমি তা ভাল অর্থেই নিতাম। [16]
আল্লাহ আমাদেরকে সকল পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের মধ্যে দাখিল করে এবং ক্রটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করে জান্নাতী বান্দা হিসাবে কবুল করুন- আমীন! (ক্রমশঃ)
লিলবর আল-বারাদী
লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী
[1]. আবুদাউদ হা/৪৮৮০; আহমাদ হা/১৯৮১৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৩৪০; হাসান ছহীহ।
[2]. রওয়াতুল উক্বালা পৃঃ ১৩১।
[3]. মুসলিম হা/১১৮৫
[4]. আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫৩৩৪।
[5]. ইবনে মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩।
[6]. ছহীহুল জামি‘ হা/৩৭৩০।
[7]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬; আহমাদ হা/২০৪৭০।
[8]. মাজমূঊর রাসায়িল, পৃষ্ঠা-৭৫৮।
[9]. মাজমু‘ ফাতাওয়া : ২৭/৫৮-৫৯ পৃ:; মিনহাজুস সুন্নাহ ৫/১৩০-১৩২ পৃ:।
[10]. বুখারী হা/৪৮; মুসলিম হা/১১৬; মিশকাত হা/৪৮১৪।
[11]. বুখারী হা/৬০৪৫; মিশকাত হা/৪৮১৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪৩১।
[12]. বুখারী হা/৬০৬৪; মিশকাত হা/৫০২৮
[13]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৯৯২; জামেউল আহাদীছ হা/৩১৬০৪।
[14]. বুখারী হা/৫১৪৩; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৫৬৮৭।
[15]. আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃঃ ১০৬।
[16]. বায়হাক্বী, মানাক্বিবুল ইমাম শাফেঈ ২/১১৬-১১৭; তাবাকাতুশ শাফেঈয়্যাহ আল-কুবরা পৃঃ ১৩৫/১৩৮।