অর্থ-বিত্ত নয়, আমাদের মূল সম্বল ঈমান ও সৎআমল

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 903 বার পঠিত

দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উল্লম্ফন, আয়ের সাথে ব্যয়ের ক্রমব্যবধান, জীবন-জীবিকার ব্যাপক সংকোচন, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনমন, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের অস্বাভাবিক সংকট আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারায় এক বড় ধরণের ধাক্কা দিয়েছে। করোনার পর আবার ঘুরে দাড়ানোর মুহূর্তে হঠাৎ এই ছন্দপতনে হতোদ্যম হয়ে পড়েছে নাগরিক জীবন। পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের বেহাল দশায় যোগ হয়েছে বাড়তি ভীতি। অজানা আশংকায় ভীতচকিত মানুষের মনজুড়ে বিরাজ করছে এক ধরণের অস্থিরতা। মনে হচ্ছে এই বুঝি আর পেরে ওঠা হবে না। সন্তান-সংসার, পরিবার-পরিজন নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা আর দুর্ভাবনায় দিন কাটাচ্ছে বহু পরিবার। দুনিয়াবী জীবনই যাদের কাছে সবকিছু, তাদের জন্য তো বটেই, দ্বীনদার পরিবারগুলোতেও নেমেছে হতাশার অাঁধার। সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষগুলো অধীর অপেক্ষায় আছেন কবে বেতন-ভাতা বাড়বে। মাত্র ১২০ টাকা দৈনিক মজুরীতে যে সব চা শ্রমিক কাজ করে এসেছেন বছরের পর বছর, তারাও আর পেরে উঠছেন না। ইতিমধ্যে তারা মজুরী বাড়াতে মরিয়া হয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জোড়া ধাক্কায় সমগ্র বিশ্বেই শুরু হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ উর্ধ্বগতি। বিশ্বজুড়ে শোনা যাচ্ছে নতুন করে অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি। মা‘আযাল্লাহ

প্রতিবার ধাক্কা আসে, আর আমরা নির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপ করি। কখনও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে, কখনও বিশ্বব্যবস্থাকে। কিন্তু আমরা হয়ত কখনও ভাবার অবকাশ পাই না যে, এসব আমাদের জন্য অবধারিতভাবে প্রাপ্য। কেননা এসব যে আমাদেরই পাপাচারের ফল! সরকার দূর্নীতিগ্রস্ত, অবিবেচকের মত তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ; কিন্তু একই অপরাধের অংশীদার কি আমরাও সমানভাবে কিংবা আরো অধিকতরভাবে নই? নইলে তেলের দাম বাড়তে না বাড়তেই অন্য সবকিছুর দাম এমন আকাশছোঁয়া কেন হ’ল? এই সিন্ডিকেটেড অপরাধের জন্য দায়ী কি সরকার? তেলের দরবৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি না রেখে রাতারাতি ইচ্ছেমত বহুগুণ দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় তো সরকার নয়, আমরাই লিপ্ত। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, সরকার জনগণের প্রতিচ্ছবি। যে দেশের জনগণ যেমন, সে দেশের সরকারও তেমন হবে-এটাই স্বাভাবিক।

আল্লাহ রাববুল আলামীন এজন্যই ঘোষণা দিয়েছেন- ‘মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসাবে স্থলে ও সমুদ্রে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে । এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের কর্মের কিছু শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (আল্লাহর দিকে) ফিরে আসে’ (সূরা রূম ৪১)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের ফসল। অনেক গুনাহ তো আল্লাহ ক্ষমাই করে দেন’ (সূরা আশ-শূরা ৩০)। অর্থাৎ দুনিয়াবী বিপদাপদ কখনও আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ আসে; তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের নিজেদেরই কর্ম প্রতিফল।

সুতরাং ঈমানদার হিসাবে এ জাতীয় বিপদাপদে আমাদেরকে প্রথমতঃ দু’টি উপায় অবলম্বন করতে হবে।

ক. তওবা ও ইস্তিগফার : যে কোন বিপদ থেকে মুক্তির জন্য যাবতীয় পাপাচার থেকে তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিকল্প নেই। সূরা হূদে এসেছে, (হূদ আঃ বলেন) তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তার দিকে ফিরে আস। (তাহলে) তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত উত্তম জীবনের স্বাদ দেবেন। এবং প্রত্যেক অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য মোতাবেক অনুগ্রহ করবেন। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উপর মহাদিনের শাস্তির আশংকা করি (হূদ ৩)

খ. ধৈর্য ধারণ : মুমিন যিন্দেগী সবসময় পরীক্ষায় ঘেরা। এই পরীক্ষায় টিকে থাকার জন্য ধৈর্য ধারণের চেয়ে উত্তম গুণ আর নেই। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা নিব। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদেরকে’ (বাক্বারা ১৫৫)

মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হ’ল সে যেমন সুখের সময় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থেকে প্রাণভরে শুকরিয়া আদায় করবে, তেমনি দুঃখ-কষ্টের সময় আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা রেখে ধৈর্য অবলম্বন করবে। কোন অবস্থাতেই সে আল্লাহকে ভুলে যাবে না এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা হারাবে না। একথা সে সর্বদা মনে রাখবে যে, রিযিকের ফয়ছালা হয় আসমানে। যে রব সুসময়ে রিযিক দিয়েছেন, সেই রব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুঃসময়েও রিযিক দিতে পারেন। তিনিই সবকিছুর মালিক ও নিয়ন্ত্রণকর্তা (বাক্বারা ২৪৫)। এজন্য ইবরাহীম বিন আদহাম (রহ.) চমৎকারভাবে বলেছেন, আল্লাহর কসম! আমি মোটেই পরোয়া করি না যদি যবের একটা দানার মূল্য এক দিনারও হয়। কেননা আমার দায়িত্ব হ’ল আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ইবাদত জারি রাখা। আর আল্লাহর কাজ হ’ল আমাকে তাঁর প্রতিশ্রুত রিযিক দান করা’। সুতরাং দিশেহারা হওয়া নয়; বরং আমাদেরকে তওবা এবং ধৈর্যের মাধ্যমে এই বিপদাবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইতে হবে। এতেই আমাদের মুক্তি নিহিত রয়েছে ইনশাআল্লাহ।

দ্বিতীয়তঃ আমাদেরকে এ বিশ্বাস সুদৃঢ় রাখতে হবে যে, দুনিয়াবী জীবন-জীবিকা, ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি কোনকিছুই আমাদের প্রকৃত সম্পদ নয়, বরং ক্ষণকালের ভোগসামগ্রী মাত্র। সুতরাং এসবের মূল্যবৃদ্ধি, ঘাটতি, ক্ষয়ক্ষতি যেন আমাদের হীনবল করে না দেয়।

কেন আমাদের মূল সম্পদ এবং আমাদের চিরস্থায়ী উপার্জন হ’ল আমাদের সেই বিশুদ্ধ ঈমান এবং সৎআমল; যাতে কোন শিরক-বিদ‘আত থাকবে না, থাকবে না রিয়া-প্রদর্শনীর মিশ্রণ। যিনি এই দু’টি অমূল্য সম্পদের অধিকারী হয়েছেন, তার মত সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই। আল্লাহ রাববুল আলামীন খুব স্পষ্টভাবেই সুসংবাদ দিয়ে বলেন, ‘তোমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি তোমাদেরকে আমার নৈকট্যশীল করবে না; বরং নৈকট্যশীল হবে তারাই, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎআমল করেছে। আর তাদের জন্য তাদের কর্মফলস্বরূপ রয়েছে বহুগুণ পুরষ্কার। আর তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে বসবাস করবে’ (সাবা ৩৭)। সুতরাং যতক্ষণ আমাদের ঈমান আছে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সৎআমল করার তাওফীক আছে, ততক্ষণ আমরা শত বিপদের মধ্যেও সম্পদশালী। শত দুর্বলতার মাঝেও ক্ষমতাবান। শত দুঃখ-বেদনার মাঝেও সর্বংসহা প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী। কেননা আমাদের মূল সম্বল, আমাদের মূল পুজি যে আছে আমাদের হাতছাড়া হয় নি। এই সম্বল যার সংরক্ষণে আছে, পৃথিবী তাবৎ বিপদাপদের বার্তা তার কাছে বিশেষ গুরুত্ব রাখে না। বরং আখেরাতের চির প্রশান্তিময় গন্তব্যের জন্য জোগাড়-প্রস্ত্ততিই হয় তার জীবনের সবকিছু। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে দুনিয়াবী যাবতীয় বিপদাপদ থেকে রক্ষা করুন এবং সর্বাবস্থায় তাঁর প্রতি ভরসা রেখে তাঁর মহা অনুগ্রহ লাভের মাধ্যম ঈমান ও সৎআমলের পথে পরিচালিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও