সালাফদের অনুসরণ প্রয়োজন কেন?
আব্দুর রহীম
ভূমিকা : সৌভাগ্যবান জীবন কে না চায়? কিন্তু সেই সুখী ও সৌভাগ্যবান জীবন অধিকাংশের কাছেই অধরা থেকে যায়। দুঃখের গ্লানি মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলে। ইসলাম মানুষের জীবনে সুখ ও সৌভাগ্যের পরশ মেলাতে সুনিয়ন্ত্রিত পথ দেখিয়েছে। নিম্নে এই পথগুলো উল্লেখ করা হ’ল।
১. ঈমান ও সৎকর্মঃ সৌভাগ্যময় জীবন লাভের অন্যতম প্রধান ও আসল উপায় হ’ল ঈমান ও সৎকর্ম। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা উত্তম পুরস্কারে ভুষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)।
সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান ও সৎআমলের সমন্বয় সাধন করতে পারবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইহকালে পবিত্র জীবন এবং পরকালে উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর এর কারণ সুস্পষ্ট। কেননা মুমিনগণ আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমানের ফলে সৎকাজ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য মন-মানসিকতা ও নৈতিক চরিত্রকে সংশোধন করে। তাছাড়া ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তি দুঃখ-কষ্টের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও শক্তি-সামর্থ সঞ্চয় করে এবং সর্ববস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্তে পরিতুষ্ট থাকে। এজন্য সে একটি পবিত্র ও সুখী জীবন যাপন করতে পারে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ‘মুমিনের কর্মকান্ডে অবাক হওয়ার বিষয় হ’ল তার সকল কাজই মঙ্গলজনক। সে সুখ-শান্তি লাভ করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে সে ধৈর্য ধারণ করে; ফলে তাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর এই সুযোগ মুমিন ব্যতীত অন্য কারও ভাগ্যে জুটে না’।[1]
সুতরাং নবী করীম (ছাঃ) জানিয়ে দিলেন যে, মুমিনের প্রাপ্তি ও কল্যাণ দ্বিগুণ। হাসি-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই সে তার কর্মকান্ডের সুফল ভোগ করবে।
অন্যদিকে যে ব্যক্তির নিকট প্রকৃত ঈমান নেই এবং ঈমানের দাবী অনুযায়ী আমল নেই, তাকে যখন অভাব-অনটন দ্বারা অথবা দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার কিছু থেকে বঞ্চিত করার দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়, তখন সে দুঃখ-কষ্টে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে যায়।
২. সৃষ্টির প্রতি ইহসানঃ সৌভাগ্যবান জীবন লাভের অন্যতম উপায় হ’ল কথা, কাজ ও সদাচরণের মাধ্যমে সৃষ্টির প্রতি ইহসান করা। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পুণ্যবান ও পাপীর কর্মকান্ড অনুসারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।
৩. উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকাঃ অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে থাকা মনকে নিয়ন্ত্রণ করার অন্যতম উপায় হচ্ছে উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা। কেননা তা মনকে ঐসব কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখে, যা তাকে অস্থির করে তোলে। ফলে সে মানসিকভাবে আনন্দ অনুভব করবে এবং তার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে।
৪. বর্তমানের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করাঃ সুখময় জীবন লাভের অপর উপায় হ’ল বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং ভবিষ্যত ও অতীতকালীন কর্মকান্ড নিয়ে চিন্তা-ভাবনা বন্ধ করা। কেননা অতীতের কোন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, যা কোন দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর ভবিষ্যতকালে কোন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকাও ক্ষতিকর। অতএব বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল তার আজকের দিন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা বর্তমান সময়কে ঘিরে ভাল কাজে ব্যয় করা। কারণ এদিকে মনোযোগ দিলেই তার কর্মকান্ড পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ হবে এবং সে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে প্রশান্তি লাভ করতে পারবে। আর নবী করীম (ছাঃ) যখন কোন দো‘আ করতেন অথবা তাঁর উম্মতকে দো‘আ করতে বলতেন, তখন তিনি আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ কামনার সাথে সাথে যা পাওয়ার জন্য দো‘আ করা হয়, তা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে উৎসাহ প্রদান করতেন। আর যা দূর করার জন্য দো‘আ করা হ’ত, তা থেকে দূরে সরে থাকতে উৎসাহ দিতেন। কারণ দো‘আ আমলের মতই। সুতরাং বান্দা দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষেত্রে তার উপকারী বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং তার উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করবে। আর এই ব্যাপারে তাঁর নিকট সাহায্য চাইবে। যেমন নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ ‘দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। প্রত্যেক বস্ত্তর মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে; যা তোমার জন্য উপকারী, তা তুমি কামনা কর এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। আর অক্ষমতা প্রকাশ করো না। কোন বস্ত্ত অর্জন করার পর এ কথা বল না যে, যদি আমি এরূপ এরূপ কাজ করতাম। বরং বল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন; কেননা যদি শয়তানের পথকে খুলে দেয়’।[2]
সুতরাং নবী করীম (ছাঃ) প্রত্যেক অবস্থায় উপকারী কর্মের কামনা করতে আদেশ করেছেন। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য চাইতে এবং দুর্বলতা ও অক্ষমতার নিকট আত্মসমর্পণ না করতে, যা ক্ষতিকারক অলসতা। তিনি আরও আদেশ করেছেন অতীতকালের বিষয় এবং আল্লাহর ফয়ছালা ও তাঁর নির্ধারিত ভাগ্যকে মেনে নেয়ার জন্য।
আর তিনি সকল কর্মকান্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম প্রকার : বান্দা তা পুরাপুরি বা অংশবিশেষ অর্জনের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় অথবা তা প্রতিরোধ করতে বা কিছুটা লাঘব করতে সক্ষম। সুতরাং এই ক্ষেত্রে বান্দা তার চেষ্টা-প্রচেষ্টার শুরু করবে এবং মা‘বুদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে। দ্বিতীয় প্রকার : এই ব্যাপারে তার ক্ষমতা নেই। সুতরাং এই ব্যাপারে সে শান্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে এবং তা মেনে নেবে। আর কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বান্দা এই নীতি মেনে চললে তা তার আনন্দ অনুভব করা ও দুশ্চিন্তা দূরীভূত হওয়ার কারণ হবে।
৫. বেশী বেশী আল্লাহর যিকিরঃ হৃদয়ের উদারতা ও মনের প্রশান্তির বড় উপায় হ’ল বেশী বেশী আল্লাহর যিকির করা। কারণ হৃদয়ের প্রশস্ততা ও মনের প্রশান্তি কায়েম করতে এবং তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করতে যিকিরের আশ্চর্য ধরনের প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়’ (রা‘দ ১৩/২৮)।
সুতরাং বান্দার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের লক্ষ্য অর্জন ও তার প্রত্যাশিত ছওয়াব ও প্রতিদান পেতে আল্লাহর যিকির বা স্মরণের বিরাট প্রভাব রয়েছে।
৬. আল্লাহর নে‘মতের আলোচনা ঃ সৌভাগ্যবান জীবনলাভের অন্যতম উপায় হ’ল আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নে‘মতের আলোচনা করা। কারণ তাঁর নে‘মত সম্পর্কে জানা এবং তার আলোচনা দ্বারা তিনি বান্দার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করেন। আর তিনি বান্দাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেন; যদিও সে অভাব-অনটন, অসুস্থতা ইত্যাদি নানা প্রকারের বালা-মুছীবতে থাকে। কারণ বান্দা যখন তার উপর আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের মধ্যে থাকে, তখন তা গণনা বা হিসাব করা সম্ভব হয় না। আর তিনি সাধারণত বান্দা যেসব অপসন্দনীয় ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, তাও বর্ণনা করে দিয়েছেন; যেসব অপসন্দনীয় বস্তু বা বিষয়ের সাথে নে‘মতের কোন সম্পর্ক নেই। বরং বিপদ-মুছীবত দ্বারা যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করেন; বান্দাও সেই ব্যাপারে ধৈর্য, সন্তুষ্টি ও মেনে নেয়ার মত দায়িত্ব পালন করে, তখন বিপদের সেই চাপটি সহ্য করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর ছওয়াব ও প্রতিদানের আশা এবং ধৈর্য ও সন্তুষ্টির সাথে কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করার দ্বারা সে তিক্ত বস্ত্তকে মিষ্টি বস্ত্ত মনে করে। ফলে প্রতিদানের স্বাদ বান্দাকে ধৈর্যের তিক্ততার কথা ভুলিয়ে দেয়। ফলে সহজেই সে সুখী জীবন লাভ করে।
৭. জীবনোপকরণের ক্ষেত্রে অধঃস্তন ব্যক্তিদের প্রতি লক্ষ্য করাঃ রাসূল (ছাঃ) বলেন, انْظُرُوا إِلَى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ‘তোমরা তোমাদের চেয়ে নিম্নস্থ ব্যক্তির দিকে তাকাও। আর তোমাদের ঊধর্বতন ব্যক্তির দিকে তাকিও না। কারণ তোমাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতকে তুচ্ছ না ভাবার এটাই উত্তম পন্থা’।[3]
সুতরাং বান্দার কপালে যখন গৌরবময় ভাগ্যরেখা অঙ্কিত হয়, তখন সে নিজেকে সুস্থতা এবং রিযিকের ক্ষেত্রে অন্য অনেকের চেয়ে উন্নত মনে করে। ফলে তার অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দূর হয় এবং আল্লাহর নে‘মতের প্রতি তার সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যখনই আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, দ্বীনী ও দুনিয়াবী নে‘মতের প্রতি বান্দার আশা-আকাংখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হ’তে থাকে, তখনই সে তার রবকে দেখে যে, তিনি তাকে অনেক কল্যাণ দান করেছেন এবং বহু অকল্যাণ দূর করেছেন। কোন সন্দেহ নেই যে, তার এই আশা-আকাংখা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনাসমূহ দূর করবে এবং হাসি-খুশি ও আনন্দকে আবশ্যক করে তুলবে।
৮. দুশ্চিন্তার কারণগুলো দূর করা ও সুখ-শান্তি অর্জনের উপায় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া : দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করা এবং সুখ-শান্তি অর্জন করার অন্যতম উপায় হচ্ছে দুশ্চিন্তার কারণ দূরিকরণ ও সুখ-শান্তি অর্জনের উপায় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া। আর তা হচ্ছে ব্যক্তি তার অতীতে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাবে, যা তার পক্ষে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব এবং তাকে বুঝতে হবে যে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা অনর্থক কাজ। আর এ ধরনের কাজ আহাম্মকী ও পাগলামী যে, তার মন অতীতে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে উঠবে এবং ঠিক একইভাবে তার মন ভবিষ্যৎ জীবনের কাল্পনিক অভাব-অনটন, ভয়-ভীতি ইত্যাদি ধরনের দুঃখ-কষ্টের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠবে।
সুতরাং তাকে জানতে হবে যে, ভবিষ্যতকালীন বিষয়াদি অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট। তার মধ্যে ভাল-মন্দ আশা-হতাশা এবং দুঃখ-বেদনা সবই থাকতে পারে। আর তা মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর হাতে। তার কোন কিছুই বান্দার হাতে নয়। বান্দা শুধু তা থেকে কল্যাণসমূহ অর্জন এবং অকল্যাণসমূহ থেকে বাঁচার জন্য সচেষ্ট থাকবে। আর বান্দাকে আরও জানতে হবে যে, সে যখন ভবিষ্যতকালীন বিষয় নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও চিন্তা-ভাবনা থেকে ফিরে আসবে; তার ভাল-মন্দের ব্যাপারে তার প্রতিপালকের উপর ভরসা করবে এবং তার প্রতি আস্থাশীল হবে, তখন তার অন্তর শান্তি অনুভব করবে, তার অবস্থার উন্নতি হবে এবং সকল দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হয়ে যাবে।
৯. দীন, দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করার জন্য প্রার্থনাঃ যেমন নবী করীম (ছাঃ) প্রায়শই এই দো‘আ করতেন, اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِى دِينِىَ الَّذِى هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِى وَأَصْلِحْ لِى دُنْيَاىَ الَّتِى فِيهَا مَعَاشِى وَأَصْلِحْ لِى آخِرَتِى الَّتِى فِيهَا مَعَادِى وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِى فِى كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِى مِنْ كُلِّ شَرٍّ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার দ্বীনকে সংশোধন করে দাও, যা আমার কর্মকান্ডকে পাপমুক্ত রাখবে; তুমি আমার দুনিয়াকে সংশোধন করে দাও, যার মধ্যে আমার জীবন-জীবিকা রয়েছে এবং তুমি আমার আখেরাতকে সংশোধন করে দাও, যেখানে আমাকে ফিরে যেতে হবে। আর তুমি প্রতিটি কল্যাণের জন্য আমার হায়াতকে বাড়িয়ে দাও এবং খারাপ বা অকল্যাণের চেয়ে আমার জন্য মৃত্যুকে আনন্দদায়ক করে দাও’।[4] অনুরূপভাবে তিনি আরও বলেন, اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلاَ تَكِلْنِى إِلَى نَفْسِى طَرْفَةَ عَيْنٍ وَأَصْلِحْ لِى شَأْنِى كُلَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ‘হে আল্লাহ! আমি শুধু তোমার রহমতেরই প্রত্যাশা করি, সুতরাং তুমি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ো না। আর তুমি আমার সকল বিষয় সংশোধন করে দাও; তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই’।[5]
সুতরাং বান্দা যখন এই দো‘আটি বিশুদ্ধ নিয়তে মনোযোগ দিয়ে তার বাস্তব দিক নিয়ে চিন্তা-গবেষণাসহ পাঠ করবে, যার মধ্যে তার দ্বীনী ও দুনিয়াবী ভবিষ্যৎ কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তখন আল্লাহ তার প্রার্থনা ও প্রত্যাশা বাস্তবে রূপান্তরিত করবেন এবং তার দুশ্চিন্তাকে খুশী ও আনন্দে পরিণত করবেন।
১০. বিপদ-মুছীবত লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করাঃ বান্দা যখন দুর্ঘটনা কবলিত হয়, তখন তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম কার্যকারী উপায় হ’ল তা লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করা এবং তার জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করে নেয়া। তার এই প্রস্ত্ততি ও ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনার দ্বারা তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তাসমূহ দূর হবে।
সুতরাং যখন তাকে ভয়-ভীতি, রোগ-ব্যাধি, অভাব-অনটন আচ্ছন্ন করে ফেলবে, তখন সে যেন এতেই প্রশান্তি লাভ করে এবং নিজের জন্য এই পরিবেশকে অথবা তার চেয়ে আরও কঠিন পরিবেশকে আপন করে নেয়। কারণ দুঃখ-কষ্টের সম্ভবনাময় পরিবেশে কোন ব্যক্তি বসবাস করলে তার জন্য তা থেকে উত্তরণ সহজ হয় এবং তার ভয়াবহতা দূর হ’তে থাকে। বিশেষ করে যখন সে নিজেকে তার সাধ্যানুযায়ী দুঃখ-কষ্ট প্রতিরোধে ব্যস্ত রাখে, তখন সে বিপদ-মুছীবত দূর করার জন্য ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং দুঃখ-কষ্ট মূলোৎপাটনে আল্লাহর উপর ভরসা ও আস্থা রেখে নতুন নতুন শক্তি ও কৌশল প্রয়োগে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। কোন সন্দেহ নেই যে, বান্দার ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন প্রতিদান লাভের আশা-আকাঙ্খার সাথে সাথে সুখ-শান্তি ও হৃদয়ের প্রসারতা ও উদারতার গুণ অর্জনে এসব কর্মকান্ডের বিরাট উপকারিতা রয়েছে। আর এটা অভিজ্ঞতালব্ধ দৃশ্য বা দৃষ্টান্ত, যা সংঘটিত হয় অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে।
১১. মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্পনাপ্রসূত অস্বস্তি, আবেগ-উত্তেজনা বর্জন করা : মানসিক ও শারীরিক রোগ চিকিৎসার অন্যতম উপায় হচ্ছে মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্পনাপ্রসূত অস্বস্তি ও আবেগ-উত্তেজনা বর্জন করা, যা দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার জন্ম দেয়। কারণ মানুষ যখন কল্পনার নিকট আত্মসমর্পন করে এবং্র তার মন যখন রোগব্যাধি, ক্রোধ, বেদনাদায়ক কারণে বিশৃঙ্খলা, দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হওয়া ইত্যাদির প্রভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে, এসব তখন তাকে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মানসিক ও শারীরিক রোগ এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দেয়; তার এমন অনেক কুপ্রভাব রয়েছে, যার বহু ক্ষতিকারক দিক সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করে।
১২. আল্লাহর উপর ভরসা করা : যখন বান্দার অন্তর আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হয়, সে নিজেও তার (আল্লাহর) উপর ভরসা করে, আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার নিকট আত্মসমর্পন না করে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়, আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয় এবং প্রভুর অনুগ্রহের আশা-আকাঙ্খা রাখে, তখন তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনাসমূহ দূর হয় এবং তার মানসিক ও শারীরিক রোগসমূহ সেরে যাবে। আর মানসিক শক্তি, উদারতা ও প্রফুল্লতা অর্জিত হবে। উল্লেখ্য যে, হাসপাতালগুলো ভরপুর হয়েছে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনাগ্রস্ত মানসিক রোগীদের দ্বারা। অনেক শক্তিশালী লোকও এ কারণে বুদ্ধিহীন ও পাগলে পরিণত করেছে। এর প্রভাব থেকে শুধু ঐ ব্যক্তিই বেঁচে গেছে, যাকে আল্লাহ ক্ষমা করেছেন এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি ও মনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার ফলপ্রসু উপায় অবলম্বনের তাওফীক দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট’ (তালাক ৬৫/৩)।
সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসাকারী ব্যক্তি মানসিকভাবে শক্তিশালী, যাকে কোন কুধারণা ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা প্রভাবিত করতে পারে না।
এতদসত্ত্বেও সে জানে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনি তার সকল দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে সে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয় এবং তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। এতে তার দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর হয়; দুঃখ সুখে পরিণত হয়; কষ্ট আনন্দে রূপান্তর হয় এবং ভয়-ভীতি পরিণত হয় নিরাপত্তায়। সুতরাং আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুস্থতা কামনা করছি এবং আরও প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের উপর অনুগ্রহ করেন, যে ভরসার কারণে আললাহ তার সকল কল্যাণের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং সকল অকল্যাণ ও ক্ষয়-ক্ষতি থেকে নিরাপদে রাখবেন।
১৩. মন্দ আচরণের পরিবর্তে ইহসান করাঃ নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ ‘কোন মুমিন বান্দা কোন মুমিন বান্দীকে ঘৃণা করবে না। তার কোন আচরণকে সে অপসন্দ করলেও তার কোন কোন আচরণকে সে পসন্দ করবে’।[6]
চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ ও বিপদ-মুছীবতের সময় নিজেদেরকে ধৈর্য ধারণ করা ও শান্ত থাকার প্রবোধ দিয়ে থাকে। কিন্তু তারাই আবার অনেক তুচ্ছ বিষয়ে অস্থির হয়ে উঠে এবং পরিচ্ছন্নতাকে পঙ্কিলতায় পরিণত করে। এর একমাত্র কারণ হ’ল, তারা বড় বড় বিষয়ের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে দায়িত্ববান মনে করে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের ক্ষেত্রে তেমন দায়িত্ববান মনে করে না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং বুদ্ধিমান লোক নিজেকে ছোট ও বড় সকল বিষয়েই দায়িত্ববান মনে করে এবং এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে। এক মুহূর্তের জন্যও সে নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করে না। ফলে তার নিকট ছোট-বড় সকল সমস্যাই সহজ হয়ে যায় এবং সে প্রশান্ত হৃদয়ে বহাল তবিয়তে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকে। (ক্রমশঃ)
[লেখক : মূল শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী লিখিত ‘আল-অসায়েলুল মুফীদাহ লিল হায়াতিস সাঈদাহ’ বইটি অবলম্বনে]
[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৭।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৮।
[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৪২।
[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৮৩।
[5]. আবুদাউদ হা/৫০৯০; মিশকাত হা/২৪৪৭।
[6]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩২৪০।