অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 615 বার পঠিত

[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর শূরা সদস্য ও কেন্দ্রীয় দাঈ অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ (রাজশাহী) (জন্ম : ১৯৫৫ খ্রি.)। পিরোজপুরের একটি কলেজে দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছরের শিক্ষকতা জীবন যাপন করেছেন। একই সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে নিয়োজিত থেকেছেন দ্বীনের দাওয়াতের কষ্টকর ময়দানে। বিশেষতঃ মাঠ পর্যায়ে দক্ষিণবঙ্গসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নিরলসভাবে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। নিভৃতচারী এই মানুষটির জীবনকাহিনীর উপর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্বিমাসিক পত্রিকা ‘তাওহীদের ডাক’-এর নির্বাহী সম্পাদক ড. মুখতারুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।]

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম কোথায় ও কখন হয়েছিল?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : রাজশাহী যেলার মোহনপুর থানাধীন জাহানাবাদ গ্রামে আমার জন্ম। ১৯৫৫ সালের ২৩শে মে ৬ই জ্যৈষ্ঠ মোতাবেক পহেলা শাওয়াল রোজ সোমবার। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন খুব ভোরে।

তাওহীদের ডাক : আপনারা কি পারিবারিকভাবে আহলেহাদীছ?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : না। পিতৃ ও মাতৃ উভয় দিক থেকে হানাফী মাযহাবের অনুসারী পরিবারে আমার জন্ম। আমার নানা রাজশাহী শহরের পঞ্চবটীর পীর শাহ ইসমাঈল চিশতীর খাছ মুরীদ ছিলেন। দাদা হাজী হসবুদ্দীন মন্ডল ও পিতা মুহাম্মাদ শামসুদ্দীন মন্ডল জাহানাবাদ গ্রামের স্থানীয় পীর ‘খন্দকার’ ছাহেবদের একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন। আমার প্রতিবেশী বড় চাচা মৃত আবুল কাসেম ও তার জামাই হাবীবুর রহমান মন্ডল বৃটিশ আমল থেকেই জামিরা জামা‘আতের অনুসারী, ‘হেদাতী’, ‘মুহাম্মাদী’ ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে আমার ছোট ভাই আব্দুস সাত্তার আবুল কাসেম চাচার সেজো ছেলে রুস্তম আলীর নিকট আরবী কায়েদা-সিপারা ও কুরআন মাজীদ শেখার প্রাক্কালে তার সংস্পর্শে গিয়ে মুহাম্মাদী হয়ে যায়। এসময় আমার পিতা ও আমি তাকে ভীষণভাবে গালিগালাজ করি এবং তাকে বাধা দেই। আলহামদুলিল্লাহ এর দু’বছর পরই ঝিনা ইসলামিয়া মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে সেখানকার ‘মুছল্লী’ ও ওস্তাদজী মাওলানা আব্দুল খালেকের সাহচর্য পেয়ে আমিও আহলেহাদীছ হয়ে যাই। তারপর গ্রামে এসে দাওয়াতী হিকমাহ ব্যবহার করে বিশুদ্ধ ইসলাম তথা আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচারকাজ শুরু করি। আমি কিছু ভিন্নধর্মী পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। যেমন-

প্রথমত: গ্রামের তিন পাড়ার যুবক ও মুরববীদের নিয়ে বৈঠকে বসে একটি পাঠাগার স্থাপনের প্রস্তাব করি। সকলেই রাযী হয়ে যায়। জাহানাবাদ হাটের উপর স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে মাটির ঘর তৈরী ও ‘দারুল হিকমাহ’ নামে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা হয়। হাবীবুর রহমান ও আবুল কাসেম চাচার সংগ্রহে রাখা বই-পুস্তক যেমন- ফিক্বহে মুহাম্মাদী, তরীকায়ে মুহাম্মাদী, ছহীহ নামায শিক্ষা, মকছেদুল মোমেনীন (যার মধ্যে লেখা আছে ১৩০ ফরজের গণনায় ৪ মাযহাব ও ৪ কুরসী, যেই ৮ ফরযিয়াতের কোন দলীল নেই), বঙ্গানুবাদ মিশকাত, বুখারী, মুসলিম, মাওলানা আহমাদ আলী রচিত সংসার পথে, আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী বা মযহাবে আহলেহাদীছ, ফাতেহা ও আমীন সমস্যার সমাধান, কোরআন ও কলেমাখানি। আমার সংগ্রহ করা ছোট বড় বিভিন্ন প্রকার বই-পুস্তক দিয়ে লাইব্রেরীটি সাজানো হয়। বই-পুস্তক পাঠ করে লোকজন হক্বের সন্ধান পেল। আল্লাহর অশেষ রহমতে তিন পাড়ার প্রায় ৫০টি পরিবার আস্তে আস্তে আহলেহাদীছ হয়ে যায়। গ্রামের ‘খন্দকার’ ছাহেবরা নানা প্রলোভনের মাধ্যমে আমাকে আহলেহাদীছ মানহাজ প্রচার করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। এমনকি আমার পিতার উপরও চাপ সৃষ্টি করেছিল। মজার বিষয় হ’ল, জাহানাবাদ গ্রামে বেশ কয়েকটি হানাফী মসজিদ আছে। তন্মধ্যে আমাদের পশ্চিম পাড়ার মসজিদটি বিনা বাধায় ও নির্বিঘ্নে আহলেহাদীছ মসজিদে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে এটি তাওহীদ ট্রাস্ট কর্তৃক পুনঃ নির্মিত হয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ!

তাওহীদের ডাক : আপনার পড়াশোনা ও উচ্চ শিক্ষা কিভাবে শুরু হয়েছিল?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : ১৯৭৪ সালে আমি এসএসসি পাশ করি। আর ১৯৭৫ সালের ঠিক ফেব্রুয়ারী মাসে গোদাগাড়ী থানাধীন ঝিনা দারুল উলূম ইসলামিয়া মাদ্রাসায় পড়তে যাই। সেখানে একেবারে প্রাথমিক দিক থেকে অর্থাৎ কুরআন মাজীদ ও ঊর্দূ কায়েদা পড়ার মধ্য দিয়ে আমার মাদ্রাসা শিক্ষা শুরু হয়। ওখানে আমি দু’বছরের মধ্যে হেদায়াতুন নাহু পর্যন্ত পড়েছিলাম। সেখানে মেশকাত পর্যন্ত পড়ানো হ’ত। ঐ সময় আমি শিক্ষক হিসাবে পেয়েছি মাওলানা আব্দুল খালেক মুর্শিদাবাদী (গোগ্রাম, গোদাগাড়ী), মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম (নরেন্দ্রপুর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ) ও মাওলানা মুহিউদ্দীন বাসুদেবপুরী।

তারপর ১৯৭৭ সালে ঢাকায় অবস্থিত কোন মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার জন্য মনস্থির করি। সেই সুবাদে রাজশাহীতে তৎকালীন জমঈয়তে আহলেহাদীছের সহ-সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক ড. আফতাব আহমাদ রহমানীর সাথে তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করি। তাঁর কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আমি ঢাকায় সাপ্তাহিক ‘আরাফাত’ পত্রিকার অফিসে উঠি। পরে ‘আরাফাত’ পত্রিকার সম্পাদক আব্দুর রহমান বিএবিটি ছাহেবের পরামর্শ নেই। তিনি আমাকে ময়মনসিংহ যেলার ত্রিশাল থানাধীন চকপাঁচপাড়া মাদ্রাসায় ভর্তি হ’তে বলেন।

এরই কয়েকদিন পরে হাফেয রূহুল আমীন ছাহেব (বর্তমান এমপি) মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন বংশাল বড় মসজিদে এসে তাফসীর করছিলেন। কিছু দ্বীনি ভাই বললেন, বংশাল বড় মসজিদে হাফেয রূহুল আমীন এসেছেন, ভাল তাফসীর করেন, চলেন শুনতে যাই। তার বক্তব্য শুনার পরে বললাম, আমি আপনাদের চকপাঁচপাড়া মাদ্রাসায় পড়তে যেতে চাই। তখন তিনি তার ওস্তাদ আবুল বাছীর আব্দুল্লাহ খানকে উর্দূতে একটা চিঠি লিখে দিলেন। ঐ চিঠি নিয়ে চকপাঁচপাড়া মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হ’লাম। এটা ১৯৭৭ সালের ঘটনা।

তখন ঐ মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসাবে আবুল বাছীর আব্দুল্লাহ খাঁন ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেযগার, সুন্নাতের পাবন্দ ও মুহাক্বিক আলেমে দ্বীন। আর তাঁরই পিতা দেলদুয়ারের মাওলানা মুহিউদ্দীন খাঁন, যার কথা স্যারের থিসিসে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি একজন প্রখ্যাত দাঈ ও দ্বীনে খাদেম ছিলেন।

১৯৭৯ সালে সেখান থেকে চলে আসি। তারপর ১৯৮০ সালে বগুড়ার সোনাতলাস্থ নাজির আখতার কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে এইচএসসি পাস করে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাসে চান্স পেয়েছিলাম। শেষে বাংলা বিভাগে ১৯৮২-৮৩ সেশনে প্রথমে ভর্তি হই। বাংলা বিভাগে দুই মাস ক্লাস করলাম। কিন্তু আমার দাড়ি থাকার কারণে ডিপার্টমেন্টের স্যারেরা খুব টিটকারী ও হাসিঢাট্টা করতেন। আর বাংলা বিভাগে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রী বেশী ছিল। তারা অধিকাংশ সময় গান-বাজনাসহ অনৈসলামিক কার্যকলাপ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। যা আমার নিকট খুব অসহনীয় ছিল।

এদিকে ততদিনে আরবী বিভাগের শিক্ষক আমীরে জামা‘আত ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাঁর সাথে পরামর্শ করলে তিনি আমাকে তাঁর বিভাগে মাইগ্রেশন করে আসতে বললেন। তখন বাংলা বিভাগ পরিবর্তন করে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে চলে এলাম। সেসময় আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ একই সাথে ছিল।

তাওহীদের ডাক : আপনার চাকুরী জীবন কখন শুরু হয়েছিল?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : ১৯৮৬ সালে আমার এমএ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে পরীক্ষা হ’ল ৮৯-এর শেষ দিকে। রেজাল্ট হ’ল ১৯৯০ সালের মে মাসে। রেজাল্ট হওয়ার আগেই পটুয়াখালী যেলার মৌকরণ ডিগ্রী কলেজে দরখাস্ত করে যোগদান করেছিলাম। ঐখানে গিয়ে দেখি কলেজের অবস্থা ভাল নয়। তাই চলে আসলাম। বাড়ীতে মাস দুয়েক বসে থাকলাম। ১৯৯০ সালে আগস্ট মাসে ইত্তেফাক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে পিরোজপুর যেলার স্বরূপকাঠী থানাধীন কুড়িয়ানা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ কলেজে দরখাস্ত করলাম। ঐ কলেজে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিন বছর ছিলাম। অতঃপর একই থানার কৌড়িখাড়াস্থ ফজিলা রহমান মহিলা কলেজে ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে যোগদান করি। এ কলেজ থেকেই গত ২০১৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করি। দুই কলেজ মিলে আমি প্রায় ২৭ বছরের মত শিক্ষকতা করেছি। স্বরূপকাঠী কুড়িয়ানা কলেজে ইন্টারভিউয়ের সময় ইউএনও মতীউর রহমান আহলেহাদীছ সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করেন। তিনি আমার উত্তর শুনে সন্ততষ্ট হন। ভাবলাম চাকুরী হবে না। কিন্তু হয়ে গেল। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বরিশাল যেলার উযীরপুর থানার হাবীবপুর কলেজের ইন্টারভিউতে। সেখানে এমপি রাশেদ খান মেনন এবং জমঈয়তে মুদাররিসীনের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল লতীফ উপস্থিত ছিলেন। মহাসচিব ছাহেব বললেন, ‘আপনি তো আহলেহাদীছ, তাই না? রাফউল ইয়াদাইনের একটি হাদীছ বলুন। আমি ভাবলাম চাকুরীই হবে না। আল্লাহর রহমতে সেখানেও চাকুরী হয়েছিল।

তাওহীদের ডাক : আপনার সাংগঠনিক জীবন কিভাবে শুরু হয়েছিল। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : ১৯৭৮ সালে আমীরে জামা‘আত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠন করলেন। ‘যুবসংঘ’ গঠনের ঘটনা আমরা ‘আরাফাত’ পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তখন বিভিন্ন যেলায় শাখা গঠন হচ্ছিল। চকপাঁচপাড়া মাদ্রাসায় আমরা শাখা গঠন করলাম। ময়মনসিংহের আব্দুল হাফীয ছিলেন কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক। কিছুদিন পর তিনি চকপাঁচপাড়া মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। এদিকে আমাদের রাজশাহী রাণীবাযার মাদ্রাসায় শাখা গঠন হয়েছে। ছুটিতে বাড়ি এসে আমি মোহনপুর থানার মধ্যে মেলান্দি, পিয়ারপুর, খানপুর, সেন্দুরি, মতিহার, জাহানাবাদ বিভিন্ন এলাকায় ‘যুবসংঘে’র শাখা গঠন করলাম। এসময় পিয়ারপুরের আযহার, রুস্তম ও ‘যুবসংঘে’র বর্তমান কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ও তাওহীদের ডাক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আসাদুল্লাহ আল-গালিবের বাবা আব্দুল আযীয আমার সঙ্গী ছিল। এভাবেই আমি সংগঠনের সাথে একেবারে শুরু থেকে জড়িত হয়ে পড়ি।

আমি যখন ময়মনসিংহ থেকে একবারে চলে আসলাম, তখন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপযেলার পাকড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত ঝিনা গ্রামের মুহাম্মাদ মুসলিম, আব্দুল খালেক প্রমুখকে দাওয়াত দিয়ে সংঘবদ্ধ করে ঝিনা এলাকা কমিটি গঠন করি। ঝিনা, উপর বিল্লি, নামো বিল্লি, আলোকছত্র, প্রসাদপাড়া বেশ কয়েকটা গ্রামে আমি শাখা গঠন করেছি। তখনো ড. গালিব স্যার ঢাকায় ছিলেন। এটা ১৯৭৯ সালের ঘটনা। গালিব স্যার ১৯৮০ সালের ১০ই ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। সে বছরই আমি এইচএসসিতে ভর্তির জন্য নাজির আখতার কলেজ, সোনাতলা, বগুড়ায় চলে গেলাম। স্যার রাজশাহীতে আসার পর আব্দুল খালেক মাস্টার, মুসলিম ভাই আর ঝিনার আব্দুশ শাকুর ভাই স্যারের কাছে যাতায়াত শুরু করলেন। এরপরে ঝিনাতে একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরী হ’ল ও পরবর্তীতে ঝিনায় যেলা সম্মেলনে স্যার প্রধান অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন।

তাওহীদের ডাক : পিরোজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল আপনার কর্মস্থল। সেই এলাকায় আপনার দাওয়াতী কাজটা কিভাবে শুরু করেছিলেন?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : আমি যখন কুড়িয়ানা কলেজে ছিলাম তখন কোন আহলেহাদীছ পাইনি। কুড়িয়ানা কলেজটি ছিল সন্ধ্যা নদীর পূর্বপাড়ে। যখন আমি সন্ধ্যা নদীর পশ্চিমপাড়ের ফজিলা রহমান মহিলা কলেজে আসলাম, তখন বেশ কয়েকটি আহলেহাদীছ মসজিদ পেলাম। যেমন এক কিলোমিটার দূরে সোহাগদল মসজিদ, দুই কিলোমিটার দূরে ভাইজোড়া মসজিদ ও তিন কিলোমিটার দূরে আদর্শ বয়া মসজিদ প্রভৃতি। এই তিনটি মসজিদে ‘যুবসংঘ’-এর শাখা করেছিলাম। ১৯৯৪ সালে ‘আন্দোলন’ গঠিত হ’লে সেখানে ‘আন্দোলনে’র শাখা গঠন করেছি। এরপরে পিরোজপুর যেলার কাউখালি, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর সদর ইন্দুরকানি ও নাজিরপুর উপযেলায় ‘আন্দোলনে’র দাওয়াত পৌঁছে দেই ও সাথে সাথে বেশ কিছু শাখা গঠন করা হয়। আমার দাওয়াতে কলেজে দু’জন সহকর্মী আহলেহাদীছ হয়েছিলেন।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আত কি কখনো সেখানে গিয়েছিলেন? আর বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে আপনি সাংগঠনিক কাজ কিভাবে এগিয়ে নিয়েছেন?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : আমীরে জামা‘আত পিরোজপুরে দুইবার গিয়েছিলেন। উপরোল্লিখিত মসজিদগুলো ট্রাস্টেরই করে দেওয়া। প্রথমবার ১৯৯৭ সালের ২১শে নভেম্বর, শুক্রবার পিরোজপুর সোহাগদলে যেলা সম্মেলনে গিয়েছিলেন। ১৪ জন যেলা সভাপতি ও অন্যান্য কর্মীবৃন্দ সহ বিশাল এক কাফেলা নিয়ে ছিল সেই সফর। দ্বিতীয়বার ২০১০ সালের ১৯শে এপ্রিল, রোজ সোমবার অনুষ্ঠিত যেলা সম্মেলনে গিয়েছিলেন।

আলহামদুলিল্লাহ আমি পিরোজপুর যেলা ‘আন্দোলনে’র প্রথম আহবায়ক ছিলাম এবং পরবর্তীতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আমি বরিশাল যেলার উযীরপুর থানায় ‘আন্দোলনে’র দাওয়াত নিয়ে গিয়েছি। বরিশাল যেলা ‘আন্দোলন’-এর বর্তমান সভাপতি ইব্রাহীম কাওছার সালাফীর আববা আয়েন আলী মাস্টারকে প্রথম দাওয়াত দিই। তাঁকে প্রথম যেলা সংগঠনের আহবায়ক করি এবং টানা দুই সেশন তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, আমার ছেলে ইব্রাহীম কাওছার সালাফী জমঈয়তের মাদ্রাসায় চাকুরী করে এবং জমঈয়ত করে। জমঈয়তের তো তেমন কোন কাজ নেই। সে তো এখন ‘আন্দোলন’ করতে চায়। কিন্তু কোন সূত্র পাচ্ছে না। আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো কথা। অতঃপর তাকে দায়িত্বে আনা হ’ল। ইব্রাহীম কাওছার সালাফী সভাপতি হওয়ার পর থেকে বরিশাল যেলায় আলহামদুলিল্লাহ আমাদের দাওয়াতী কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে তার ছোট ভাই কায়েদ মাহমূদ ইমরান ‘যুবসংঘে’র যেলা সভাপতি। এরপর বরিশাল (পূর্ব) মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়ায় দাওয়াত নিয়ে যাই। আগে থেকেই তারা আত-তাহরীক পড়তো। ফলে তারা সহজেই দাওয়াত কবুল করে এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’ যোগদান করে।

বরগুনা শহরে একটা আহলেহাদীছ মসজিদ ছিল। কিন্তু সেখানে বাংলায় নয়, বরং আরবীতে মাযহাবী নিয়মে খুৎবা হ’ত। মেজর আব্দুল মান্নান ও অধ্যাপক নূরুল আলম বললেন, আমরা জানি বাংলায় খুৎবা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে নতুন জায়গা। বাংলায় খুৎবা দিলে সমস্যা হ’তে পারে। আমি বললাম, আগামীকাল আমি বাংলায় খুৎবা চালু করি। পরীক্ষা করে দেখা যাক, কোন প্রতিক্রিয়া হয় কি-না। তারা আমাকে অনুমতি দিলেন আমি বাংলায় খুৎবা দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়নি। কেউ তো বিরূপ মন্তব্য করেইনি বরং সবাই সাদরে গ্রহণ করে। আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত সেখানে বাংলায় খুৎবা হচ্ছে। পরবর্তীতে সেখানে ‘আন্দোলন’-এর যেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এখন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

আমি বরিশালের পর্যটন যেলা পটুয়াখালী সদরেও দাওয়াত নিয়ে গিয়েছি। পটুয়াখালী সরকারী কলেজের মুজিবুর রহমান ভাইকে প্রথমে দাওয়াত দেই। তিনি প্রথম থেকেই সংগঠনের দাওয়াত কবুল করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ যেলা ‘আন্দোলন’ সভাপতি মুহাম্মাদ আহসান ভাই বাউফল উপযেলার সানেশ্বরে যে মসজিদ করে দিয়েছেন, সেখানে দাওয়াত নিয়ে গিয়েছি।

এরপর ১-৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯-এ ভোলা বোরহানুদ্দীন থানার কাচিয়া-চৌমুহনী তা‘লীমুল মিল্লাত মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত বিরাট তাফসীর মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসাবে আমীরে জামা‘আত যোগদান করেন। মোশাররফ হোসেন আকন্দ ও মাওলানা ছফিউল্লাহর সহযোগিতায়। সেখানে তিনি ‘আন্দোলন’-এর দাওয়াত দেন। এর এক বছর পর আমি সেখানে যাই। পরবর্তীতে আমি ও যশোরের সিরাজুল ইসলাম ভাই ভোলা শহরে উত্তর বাপ্তায় কামরুল ইসলামের এলাকায় যাই। পরে ২০১৯ সালে কামরুল ইসলামদের মসজিদ ভাঙ্গা ঘটনার পর সর্বপ্রথম আমি সেখানে সরেযমীনে দেখতে যাই এবং কেন্দ্রে এসে আমীরে জামা‘আতের সাথে পরামর্শ করি। আলহামদুলিল্লাহ সেখানে এখন সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

বরিশালের অপর যেলা ঝালকাঠির বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি কিন্তু সেখানে সংগঠনের শাখা গঠন করতে পারিনি। লোকজন খুবই কম, যারা আছে সবাই ঢাকায় থাকে। আর তারা আহলেহাদীছ বিভিন্ন জায়গাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মাদারীপুর যেলার কালকিনিসহ বিভিন্ন স্থানে দাওয়াত নিয়ে গিয়েছি। তবে অনেক বিলম্বে হ’লেও গত ১০ই আগস্ট’ ২২ তারিখে মাদারীপুর শহরে আলহামদুলিল্লাহ যেলা আহবায়ক কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়েছে। বহুদিনের প্রচেষ্টার ফল হিসাবে গত ৬ই আগস্ট’২২ তারিখে বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন নিয়ামতি ইউনিয়নে ‘আন্দোলনে’র একটি শাখা কমিটি গঠন করতে পেরেছি। এমনিভাবে পুরা বরিশাল বিভাগে আমি সাধ্যমত আন্দোলনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ।  

তাওহীদের ডাক : জমঈয়ত ও যুবসংঘে’র মধ্যে কিভাবে দূরত্ব সৃষ্টি হ’ল। আপনি নিয়মিত ‘আরাফাত’ পড়তেন আপনার কাছে কি মনে হয়?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : আমি যতটুকু দেখেছি বা জেনেছি তাতে একথা স্পষ্ট যে, এতে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কোন ভুল ছিল না। মূলতঃ আমীরে জামা‘আতের সাথে জমঈয়তে আহলেহাদীসের যে মতপার্থক্য ঘটেছে- সেটা একটা আদর্শিক বিষয়। যেমন জমঈয়ত নেতৃবৃন্দ মনে করতেন, যেকোন ব্যক্তি আহলেহাদীছ পরিবারে জন্ম নিলেই জমঈয়তের সদস্য হ’তে পারবে। সে জাতীয়পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী যে পার্টিই করুক, তাতে কোন যায় আসে না। কেননা জমঈয়ত একটা বটবৃক্ষ। এখানে সকল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ এসে আশ্রয় নিবে। কিন্তু ড. গালিব স্যার কখনই এ মতবাদে বিশ^াসী ছিলেন না। তাঁর কথা ছিল যে, জমঈয়ত থাকতে আহলেহাদীছ সন্তানরা কেন অন্য সংগঠনে যাবে? তারা ‘যুবসংঘ’ থাকতে অন্য কোন ছাত্র সংগঠন করবে কেন? এটা প্রথম আদর্শিক মতপার্থক্য ছিল। আর বাস্তবিকই আমরা দেখতে পাই যে, সারা দেশে জমঈয়তের দায়িত্বশীল থেকে শুরু করে সদস্যদের অধিকাংশই প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী, কম্যুনিস্ট ও ইসলামী চরমপন্থী রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত। অথচ জমঈয়তের গঠনতন্ত্রে ৮নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যে, ‘যে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আক্বীদা, আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ হইতে ভিন্ন তাহার কোন সদস্য বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছের সদস্য শ্রেণীভুক্ত হইতে পারিবে না’। [এম.এ কাফী আল-কোরায়শী কর্তৃক প্রকাশিত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গঠনতন্ত্র (২য় সংস্করণ, ১৯৯৫), পৃ. ৬।]

আরেকটা কারণ হ’ল, কর্মনিষ্ঠ ও মুখলিছ দাঈ শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী ছাহেবের সাথে স্যারের ঘনিষ্ঠতা জমঈয়ত নেতৃবৃন্দের গাত্রদাহের কারণ হয়। কেননা তাঁদের উভয়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আহলেহাদীছ জামা‘আতের নতুন গতি সঞ্চার হয়েছিল এবং দিকে দিকে ‘যুবসংঘ’-এর নাম উচ্চারিত হচ্ছিল। ফলে জমঈয়ত নেতৃবৃন্দ ‘যুবসংঘ’কে কখনই মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। অবশেষে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে যুবসংঘের সাথে ১৯৮৯ সালে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা হয় এবং একই সময়ে আব্দুল মতীন সালাফীকে মিথ্যা অভিযোগে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এটা ঘটেছিল শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রোশ ও হিংসা-বিদ্বেষের কারণে। জমঈয়তের বৃহত্তর অংশ এখনও প্রকৃত ঘটনা না জেনে গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র অভিযোগ ছড়ান যে, ‘ড. গালিব জমঈয়ত ভেঙেছেন এবং তিনি টাকা-পয়সার হিসাব দেননি’। অথচ এটা নির্জলা মিথ্যাচার। বরং জমঈয়তই ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই ঠান্ডা মাথায় ‘যুবসংঘ’-এর সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা দিয়ে এবং একই সময়ে ‘যুবসংঘ’কে ঠেকানোর জন্য একটি প্যারালাল সংগঠন হিসাবে ‘শুববান’কে দাঁড় করিয়ে আহলেহাদীছ জামাআ‘তকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। অথচ এই জ্বলন্ত সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে আজও তারা বহাল তবিয়তে মিথ্যা প্রপাগান্ডা অব্যাহত রেখেছেন। জানি না আর কতকাল এই মিথ্যার বেসাতি চলবে। আল্লাহ হেফাযত করুন!

সেই সাথে ড. গালিব স্যারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার সহজ কৌশল হিসাবে তার বিরুদ্ধে আর্থিক হিসাব দাখিল না করার ভ্রান্ত অভিযোগ রটানো হয়। অথচ তা সর্বৈব মিথ্যা অপবাদ। বরং জমঈয়তই ‘যুবসংঘ’-এর জন্য আগত অর্থ অন্যায়ভাবে আটকিয়ে রেখেছিল। সুতরাং এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই দ্বিধাবিভক্তির পিছনে পূর্ণভাবে দায়ী ছিল জমঈয়ত। যদিও জমঈয়ত আজও এই দায় স্বীকার করেনি। বরং অব্যাহতভাবে উল্টো উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে এসেছে। ফলে এই দূরত্ব সহসা দূর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে আমাদের একান্ত কামনা ও দো‘আ আল্লাহ যেন জমঈয়তের দায়িত্বশীলদের মধ্যে আন্তরিকতা ও সত্যের সাথে চলার সাহস জাগ্রত করেন এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পরিত্রাণ দেন। তবেই এদেশে আহলেহাদীছ জামাআ‘ত ঐক্যবদ্ধভাবে এবং সুসংহতভাবে বৃহত্তর কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে পারবে ইনশাআল্লাহ।  

তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে স্যার গ্রেফতার হ’লেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : তখন আমি পিরোজপুর যেলা সভাপতি ছিলাম। ঐ সময় আমার উপর দিয়ে অনেক চাপ গিয়েছিল। আমার হাতে হ্যান্ডকাপ পড়েনি বটে, কিন্তু স্যার গ্রেফতার হওয়ার কয়েক দিন আগ থেকে গোয়েন্দারা আমার উপর নযরদারী শুরু করে। তখন আমি স্যারকে মোবাইলে বললাম, স্যার-আমার উপর গোয়েন্দারা এভাবে নযরদারী করছে কারণ কী? তিনি বললেন, বিভিন্ন জায়গাতে জঙ্গীরা ধরা পড়ছে, আর আমার ও সংগঠনের নাম বলছে। সেকারণে হ’তে পারে। গোয়েন্দারা আমাকে খুবই কড়া নযরদারীতে রেখেছিল। আমি কোথায় যাই, কি করি, কোথায় বাজার করি এবং মানুষের সাথে কেমন আচরণ করি ইত্যাদি।

২০০৫ সালের ২২শে ফ্রেরুয়ারী ইজতেমার ২দিন পূর্বে স্যারকে গ্রেফতার করা হয়। আমি তা জানতে পারিনি। ইজতেমার আগের দিন আমি ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে ইজতেমায় আসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে কলেজে এসেছি মাত্র। আমার সহকর্মী জনাব শহীদুল ইসলাম বাহাদুর, যিনি আমার দাওয়াতে আহলেহাদীছ হয়েছেন। তিনি বললেন, আপনার ছেলে তাওফীকুর রহমান আমার নিকট মোবাইল ফোনে বলেছে ইজতেমা হবে না, গালিব স্যারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখন আমার ছেলে নওদাপাড়া মারকাযে আলিম ক্লাসে পড়তো। কিছুক্ষণ পর টিভির খবরে দেখলাম যে, স্যার ও ড. আযীযুল্লাহ পাশাপাশি বসে আছেন। কলেজে ক্লাস শেষে বাসায় গিয়ে স্যারের গ্রেফতারের খবর জানালে বাসায় আমার স্ত্রী, ছোট ছেলে ও এক মাত্র মেয়ে অঝোরে কান্নাকাটি করেছিল, যেমনভাবে আপনজনের কেউ মৃত্যুতে কান্নাকাটি করে।

স্যার গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ভয়েস অব আমেরিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক আনিস আহমেদ স্যারের একটি ইন্টারভিউ নিয়ে প্রচার করেছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারটি আমার ছেলে মেয়েরা টেপ রেকর্ডে ধারণ করেছিল। যা বারবার শুনতাম ও স্যারের কন্ঠস্বরের মাধ্যমে তার সাহচর্য অনুভব করতাম। এটাও আমার একটা বড় স্মৃতি।

সর্বশেষ কথা হ’ল, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ও আহলেহাদীছ জামা‘আতকে নিয়ে স্যারের যে চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা, তাতে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি আহলেহাদীছ জনসাধারণ প্রশ্নাতীতভাবে তাঁকেই অবিসংবাদিত নেতারূপে গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ তো সব অন্তরকে এক সমান করে সৃষ্টি করেননি। সর্বোপরি হিংসা, মাল ও মর্যাদার লোভ তাদেরকে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত করে রেখেছে। আল্লাহই হেফাযতের মালিক।

তাওহীদের ডাক : আপনার সাথে মুহাতারাম আমীরে জামা‘আতের প্রথম সাক্ষাৎ কিভাবে হয়েছিল? এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার সাক্ষাৎ এক বিস্ময়কর ঘটনা। ঝিনা মাদ্রাসায় থাকাকালীন আমরা বিকালে ছাত্র-শিক্ষক মিলে খেলার মাঠে বসতাম। ঐখানে আমাদের সাথে যোগ দিতেন প্রয়াত আব্দুল খালেক মাস্টার। তার কাছ থেকে সাপ্তাহিক ‘আরাফাত’ পত্রিকা পড়ার জন্য নিতাম। পরে মাদ্রাসার নামেই পত্রিকা আসত। ঐখানে প্রায় সংখ্যাতে মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব নামক একজন লেখকের লেখা পড়তাম। খুব ভাল  লাগত। একদিন আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি যে, এই লেখক তো প্রায় প্রতি সংখ্যায় লেখেন। উনার পরিচয় কি? কোন যেলায় বাড়ী? ইত্যাদি। সেদিন দুই মাইল দূরে পাকড়ি হাইস্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা আবুল কালাম আযাদ বাসুদেবপুরী আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, আমি আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে চিনি। তার বাড়ি খুলনায়। আরামনগর, জামালপুর মাদ্রাসায় আমার সহপাঠী ছিলেন। ঐখান থেকে আমরা একসাথে কামিল পাশ করেছি। স্যারের মেধা ও বিদ্যাবত্তা সম্পর্কে তিনি অনেক কিছুই বললেন। তখন থেকে জানতাম স্যারের বাড়ী খুলনায়।

১৯৭৭ সালে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় যাওয়ার পর সাপ্তাহিক ‘আরাফাত’ পত্রিকা অফিসে প্রায় আট-দশ দিন ছিলাম। উপরে ছিল আরাফাত অফিস আর নিচে নাযিরাবাজার মসজিদ। ঐখানে একদিন মাগরিবের ছালাত পড়ে বের হয়েছি, আর স্যার সাইকেল নিয়ে বের হয়েছেন। তখন স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মহসিন হলে থাকতেন। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। মুছাফাহার পরে স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ী কোথায়? আমি বললাম, রাজশাহীতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ী কোথায়? তিনি বললেন, আমার বাড়ী খুলনায়। তখন আমি স্যারকে বললাম, খুলনার আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে চিনেন কি? স্যার তখন বললেন, আমিই আসাদুল্লাহ আল-গালিব। এই হ’ল প্রথম পরিচয়ের সূত্র।

তাওহীদের ডাক : আপনি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ -এর কেন্দ্রীয় দাঈ হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছেন। কোন সাল থেকে এ ময়দানে আপনার পথ চলা শুরু?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : আমি অবসর গ্রহণ করি ২০১৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর। আমি শীতকালীন ছুটি থাকায় এমাসেই বাড়ীতে আসলাম। জানুয়ারী-মার্চ তিন মাস বাড়ীতেই বসেছিলাম। পরে আমি অধ্যাপক আমীনুল ইসলাম, ‘আন্দোলনে’র  সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ভাইকে বললাম, আমি তো বাড়ীতে বসে আছি। আমি তো বসে থাকার লোক না। আমি পিরোজপুর থাকাকালীন সবসময় বিভিন্ন জায়গায় দাওয়াতী কাজে চলে যেতাম। নূরুল ইসলাম ভাই বললেন, আপনি একটা আবেদন করেন, দেখা যাক আপনাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না? আমীরে জামা‘আত বরাবর একটা আবেদন করলাম। তারপরে ২০১৭ সালের ১লা এপ্রিল তিনি আমাকে কেন্দ্রীয় দাঈ হিসাবে নিয়োগ দেন। সেই থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে, নিভৃত গ্রাম-গঞ্জে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে আছি, সুস্থ আছি ইনশাআল্লাহ এই গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাব।

তাওহীদের ডাক : সম্প্রতি কেউ কেউ আমীর নির্বাচন ও বায়‘আতের বিরোধিতা করছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : স্যারের ডক্টরেট থিসিসে বিশদ আলোচনা রয়েছে ভাল করে পড়ে দেখুন। বায়‘আত সম্পর্কিত কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক দলীল তো আছেই। পাশাপাশি সঊদী আরবের ওয়াহ্হাবী আন্দোলন, উপমহাদেশের জিহাদ আন্দোলন প্রভৃতি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বায়‘আত গ্রহণ, শিক্ষা আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা সাইয়েদ নাযীর হোসাইন কর্তৃক শিষ্যদের নিকট থেকে বায়‘আত গ্রহণ এবং হিজরী ১৩১৩ মোতাবেক ১৮৯৫ খৃ: দিল্লীতে মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব দেহলভীর নেতৃত্বে ‘গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’ সংগঠন কায়েমের ইতিহাস জানতে পারেন। যে সংগঠনের ভিত্তি ছিল ‘ইমারত ও বায়‘আত’। রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত উক্ত মুর্দা সুন্নাতকে যিন্দা করার উদ্দেশ্যেই ১৯৯৪ সাল থেকেই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কর্তৃক এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ‘ইমারত ও বায়‘আত’ বিষয়টি অস্বীকার করা কুরআন ও হাদীছের স্পষ্ট বিধানকে অবজ্ঞা করার শামিল। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশে আমাদের পূর্বপূরুষগণ বাতিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ দাওয়াতী মিশনকে পরিচালনা করেছিলেন, সেই ইতিহাসের সাথে বিরোধিতা করার শামিল বলে আমি মনে করি। এর মধ্যে পীর-মুরিদীর গন্ধ খোঁজ করা অসৎ উদ্দেশ্যের পরিচায়ক।

আমীর ও বায়‘আতের বিরোধিতাকারীগণ হয় জ্ঞান পাপী না হয় সত্য গোপনকারী। তাদের বুঝা উচিত যে, আমীর দু’ধরনের হয়ে থাকেন। ১. রাষ্ট্রীয় আমীর ২. বিশেষ দলের আমীর। এমনিভাবে জামা‘আত দু’প্রকার  হয়ে থাকে। ১. জামা‘আতে আম্মাহ ২. জামা‘আতে খাছছাহ। জামা‘আতে আম্মাহ থাক বা না থাক, রাষ্ট্র মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক জামা‘আতে খাছছাহ থাকতেই হবে। আর জামা‘আতে খাচ্ছাহ থাকলে অবশ্যই সেখানে একজন আমীর থাকবে।

তারা বলছেন, আমীর কেবল রাষ্ট্রে থাকবে। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কোন তিন জন ব্যক্তির জন্যেও কোন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করা হালাল নয় তাদের মধ্যে একজনকে আমীর নিযুক্ত না করা পর্যন্ত’ (আহমাদ হা/৬৬৪৭, হাদীছ হাসান)। রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘যখন তিন জন একত্রে সফরে বের হবে তাদের মধ্যে একজনকে যেন আমীর নিযুক্ত করে নেয়’ (আবুদাঊদ হা/২৬০৮; নায়লুল আওত্বার হা/৩৮৭৩)

তাহ’লে এসব হাদীছের উপর আমল কিভাবে হবে? ইমারত ও বায়‘আত বিরোধী প্রবক্তাদের বুখারী ও মুসলিম এবং সুনানে নাসাঈতে বর্ণিত বিভিন্ন প্রকার বায়‘আতের ১৭টি অনুচ্ছেদের হা/৪১৩৯ হতে ৪২১১ পর্যন্ত ৪১৬০ ও ৪১৬১ দু’টি যঈফ হাদীছ বাদ দিয়ে মোট ৬০টি ছহীহ হাদীছ গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠের আবেদন রাখছি। সেই সঙ্গে আমীরে জামা‘আত কর্তৃক রচিত ডক্টরেট থিসিসের ৩৬৫-৩৬৭ পৃষ্ঠা টীকাসহ এবং ‘ইসলামী খিলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ বইটির ৯৪ পৃষ্ঠা থেকে ১০৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত  পাঠের অনুরোধ করছি।

তাওহীদের ডাক : স্যারের সাথে স্মৃতি বিজড়িত আর কোন ঘটনা আছে কি?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : স্যারের সাথে আমার বিগত ৫০ বছরের বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য যেমন-

১. ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ঢাকাতে ১৯৮০ সালের ৫ ও ৬ই এপ্রিল। এর আগে ১৯৭৯ সালে একটা জাতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল তা ‘আরাফাত’ পত্রিকায় যার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিল। সে সম্মেলনের উদ্দেশ্যে আমি ও আমাদের থানাধীন পিয়ারপুর গ্রামের রুস্তম আলী ময়ময়সিংহের ত্রিশাল থেকে ঢাকাতে গিয়েছিলাম। স্যার তখন যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় থাকতেন। স্যারের কাছে গিয়ে শুনলাম, বিশেষ কারণে সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়েছে। ঐ সময় ‘যুবসংঘে’র গঠনতন্ত্র ও কর্মপদ্ধতি ছাপা হয়নি। ‘যুবসংঘে’র গঠনতন্ত্র ও কর্মপদ্ধতি বই আকারে প্রথম মুদ্রিত হয় ১৯৮১ সালে। আমার কাছে সাদা খাতা ছিল। ঐখানে লাইব্রেরী নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেটা স্যারকে দেখালাম। স্যার দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, যদি কখনো পত্রিকা বের করি তখন ছাপানো হবে। পরবর্তীতে মাসিক ‘আত-তাহরীকে’ ২য় বর্ষ : ১ম সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৮-এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

আমার কাছে সেই খাতার শেষের দিকে বেশ কয়েকটি সাদা পৃষ্ঠা ছিল। সেখানে স্যার ‘যুবসংঘ’-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পাঁচ দফা মূলনীতি ও চার দফা কর্মসূচী- এই তিনটি জিনিস নিজ হাতে লিখে দিলেন আর মুখস্থ করতে বললেন। স্যারের লিখে দেওয়া এই তিনটি জিনিস আমার কাছে দীর্ঘ দিন ছিল।

কথা প্রসঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র যিয়ারত হোসেন, যার বাড়ী ছিল ডেউয়াতলা, চালনা বন্দর, দাকোপ, খুলনা। স্যার তার ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন, এর সাথে চিঠি আদান-প্রদান করবে। এ সেই ছেলে যে স্যারের উপর মারমুখী হয়েছিল, যখন স্যার শবেবরাত সম্পর্কে লিখেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার তাকে বুঝানোর পর সে আহলেহাদীছ হয়ে যায়। তিন বছর আগে চালনা সফরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। 

২. আমি বগুড়ার সোনাতলায় থাকতে মধুপুর গ্রামে লজিং থাকতাম। মধুপুরের ওছমান গণী ভাইকে সভাপতি করে ‘যুবসংঘ’-এর শাখা গঠন করলাম এবং ডিসি রোডের পাশে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ‘যুবসংঘ’-এর অফিস করেছিলাম। মধুপুরের অনতিদূরে হুয়াকুয়া গ্রামে জমঈয়তের যেলা কনফারেন্সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. আফতাব আহমাদ রহমানী ও গালিব স্যার প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসাবে যোগদান করেছিলেন।

৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমি সাময়িকভাবে নবাব আব্দুল লতীফ হলে অতিথি হিসাবে ছিলাম। স্যার সে সময় যোহা হলে হাউজ টিউটর হিসাবে থাকতেন। স্যারের রুমে আমি, সিরাজ ভাই, মনিরুল (কেশবপুর, যশোর) প্রমুখ যুবসংঘের বৈঠক করতাম। স্যারের রুমে তাঁর এক ভাগ্নে রূহুল আমীন থাকতেন। সে ঐ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপেক্ষা কঠিন বিষয় ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যার ছাত্র ছিল। তার বইগুলো ছিল ইংরেজী মিডিয়ামের। দেখতাম তাকে স্যার কঠিন ইংরেজী পড়ে পড়ে অর্থ ও তাৎপর্য বুঝিয়ে দিতেন। আরবীর শিক্ষক অথচ ইংরেজী ভাষার উপর স্যারের অসাধারণ দখল দেখে আমরা সকলে বিস্মিত হ’তাম।

৪. ‘যুবসংঘে’র প্রতিষ্ঠালগ্নে উত্তর যাত্রাবাড়ীর ঠিকানায় এবং পরে পিরোজপুর থাকাকালে স্যারের সাথে অসংখ্য বার পত্রালাপ করেছি। স্যারের হাতে ‘স্নেহের আব্দুল হামীদ’ লেখা চিঠি এখনও আমার সংরক্ষণে আছে। এখন সেগুলোতে চোখ বুলালে পুরানো কত স্মৃতিই মনে পড়ে!

৫. ঢাকা থেকে ১৯৮৪ সালে ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় অফিস রাজশাহী রাণীবাজার মাদ্রাসায় (২য় তলায়) স্থানান্তরিত হ’লে মাদ্রাসার ছাদে জোৎস্না রাতে স্যারের সভাপতিত্বে প্রথম যে মিটিং হয়েছিল তাতে মনীরুল, সিরাজ ভাই, এনামুল হক (চাঁপাই) ও আমি ছিলাম। এসময় আমি ও এনামুল হক রাণীবাজার মাদ্রাসায় নব প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় অফিসে থাকতাম। এসময় রাজশাহী বিভাগীয় তাবলীগ সম্পাদক হিসাবে স্যারের নির্দেশে বগুড়ার বৃ-কুষ্টিয়া, কামারপাড়া, শিবগঞ্জ, রংপুরের হারাগাছ, রংপুর সদর ও পাবনার খয়ের সুতি, শালগাড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় দাওয়াতী সফর করেছি।

৬. ২০০৫ সালের ২২শে এপ্রিল শুক্রবার রাজশাহী, সাতক্ষীরা, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, পাবনা, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন যেলায় এক যোগে স্যারের গ্রেফাতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়। প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দিতে না পারায় আমি মানসিকভাবে খুবই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। অবশেষে আমার পিরোজপুর যেলার কর্মীদের বুঝিয়ে ২৯শে এপ্রিল ২০০৫ শুক্রবার বাদ আছর ইন্দুরহাট ও মিয়ারহাট বন্দরে বিক্ষোভ মিছিল করলাম। পরের দিন ইত্তেকাফ, আমার দেশ, যুগান্তর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ‘জঙ্গীরা মিছিল করেছে’ শিরোনামে আমাদের খবর বিকৃত করে ছাপা হ’ল। সাথে সাথে স্থানীয় এম.পি শহীদুল হক জামালের নির্দেশে আমাকে থানায় ডাকা হ’ল। কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আমীনুল হক আমাকে তাঁর বাসভবনে আত্মগোপনে থাকতে বললেন এবং নিজে থানার ওসি ও ডিএসবি’র লোকদেরকে ম্যানেজ করলেন। সেদিন অধ্যক্ষ স্যারের সেই ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। তাঁর জন্য দো‘আ করি। তিনি আমার প্রতিটা ভাল কাজেই সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। 

তাওহীদের ডাক : ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আপনি কোন না কোনভাবে এর সাথে জড়িত আছেন। এ পর্যন্ত অনেক দায়িত্বশীল নেতা ও কর্মী সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যাদের আপনি চিনতেন, জানতেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পদাধিকারী সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীগণ সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। একইভাবে ১৯৯৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা লাভের পর হ’তে এ পর্যন্ত অনেক আমেলা ও শূরা সদস্যসহ বহু নেতা-কর্মী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। আমি মনে করি, এর পিছনে মৌলিক ২টি কারণ রয়েছে। প্রথমত : কিছু লোক আন্দোলনের মূল থীম ‘তাওহীদে ইবাদত’ তথা সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করা’- এ বিষয়টি ভালভাবে বুঝে আন্দোলনে যোগ দেননি। দ্বিতীয়ত : কিছু লোক আবেগের বশীভূত হয়ে সংগঠনে আসেন।

এই উভয় দলের মধ্য থেকে কিছু লোক দুনিয়াবী মতলব নিয়ে কিছু চাওয়া-পাওয়া বা স্বার্থ হাছিলের জন্য সংগঠনে যোগ দেয়। আখেরাত এদের কাছে একেবারেই উপেক্ষিত। এরাই স্বার্থ সিদ্ধির পর সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি এই স্বার্থের পিছনের ছোটা মানুষগুলোই পরে স্যারের বিরোধিতা করেছে। এরা মানসিকভাবে কুটিল, ধুরন্ধর, মতলববাজ ও অকৃতজ্ঞ।

অপরপক্ষে কেউ কেউ সংগঠনের মূল লক্ষ্য বুঝে-শুনে এবং স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি, নেকী অর্জন ও আখেরাতে মুক্তি লাভের জন্য সংগঠনে আসেন। তারা তাক্বওয়াশীল, সহজ-সরল ও কুটবুদ্ধিহীন। এরাই এখন পর্যন্ত সংগঠনে টিকে আছেন ও আমৃত্যু থাকবেন ইনশাআল্লাহ!

তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘ’-এর মুখপত্র ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : বর্তমান যুগ হ’ল সাংগঠনিক যুগ। আর এর প্রচার-প্রসারে মূখ্য ভূমিকা পালন করে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া এবং বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি। বাতিলের নানামুখী চ্যালেঞ্জ  মোকাবেলায় প্রিন্ট মিডিয়ার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশুদ্ধ ইসলাম প্রচারে ‘যুবসংঘে’র মুখপত্র তাওহীদের ডাক পত্রিকা সংগঠনের এক বিশেষ সংযোজন, যার বুকে ভর করে আছে নানা স্মৃতি, আহলেহাদীছদের বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিক আখ্যান। সুতরাং বাতিলের মোকাবিলায় হক্বের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে এর যাত্রা অব্যাহত থাকুক এ দো‘আ করছি।

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের খেদমতে যদি কিছু বলতেন। 

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : জ্ঞানার্জনের জন্য আসলে পড়ার কোন বিকল্প নেই। তাওহীদের ডাক পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটি কথা ভাল করে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আর তা হ’ল- আমাদের মধ্যে নিজেকে জানার প্রবণতা খুবই কম। অথচ আহলেহাদীছদের গর্ব করার মত ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু তারা সে বিষয়ে ওয়াকিফহাল নয়। আমীরে জামা‘আত-এর একটি মূল্যবান কথা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সে প্রকৃত জ্ঞানী নয়, যার ইতিহাসে জ্ঞান নেই’। ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকা দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবী অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। পাঠক মহলের কাছে আমার আরয তারা নিজেরা পত্রিকাটি পড়বেন এবং অন্যকে উৎসাহিত করবেন। এর গ্রাহক ও পাঠক সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হওয়া উচিত। পাঠকদের কাছে দো‘আ চাই- আমি যেন আমৃত্যু দাওয়াতী কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পারি।

তাওহীদের ডাক : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য। 

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ : আপনাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা রইল। জাযাকুমুল্লাহ খায়রান। মহান আল্লাহ আমাদের সকলের কল্যাণ করুন-আমীন!



আরও