মা দিবস ও বৃদ্ধাশ্রম : ইসলামী দৃষ্টিকোণ
লিলবর আল-বারাদী
মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 674 বার পঠিত
ইসলামী শরী‘আতে শাস্তি তিন প্রকার যথা-
প্রথমত : বিভিন্ন ধরনের কাফফারা : এমন শাস্তি যা মহান আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত : হদ ও কিছাছ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) : এমন সব শাস্তি যা আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) বা রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত এবং এগুলো কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় সরকারের। এক্ষেত্রে বিচারক বা সরকারের নিজস্ব মতামতের কোনো সুযোগ নেই। এ অপরাধ সংঘটিতকালে একদিকে যেমন সৃষ্টিজীবের প্রতি অন্যায় করা হয়, তেমনি অন্যদিকে স্রষ্টার নাফরমানী করা হয়। ফলে অপরাধী আল্লাহ ও তাঁর বান্দা উভয়ের কাছে দোষী বলে বিবেচিত হয়। এই শাস্তি হচ্ছে ‘আল্লাহর অধিকার এবং তা কেউ ক্ষমা করতে পারে না’।
হদ ও কিছাছের মধ্যে পার্থক্য এই যে, হদকে আল্লাহর হক হিসাবে প্রয়োগ করা হয় বিধায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলেও হদ অকার্যকর হবে না। যেমন যার সম্পদ চুরি হয়ে যায়, সে ক্ষমা করলেও চোরকে নির্ধারিত শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু ‘কিছাছ’ এর বিপরীত। কিছাছে বান্দার হক প্রবল হওয়ার কারণে হত্যা প্রমাণ হওয়ার পর হত্যাকারীর বিষয়টি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর ইখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া হয়। সে ইচ্ছা করলে বিচার বিভাগের মাধ্যমে কিছাছ হিসেবে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে পারে কিংবা দিয়াত-রক্তপণ গ্রহণ করতে পারে কিংবা ক্ষমা করে দিতে পারে।
তৃতীয়ত : তা‘যীর : ইসলামী শরী‘আত যেসব অপরাধের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করেনি বরং বিচারকের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েছে তাকে তা‘যীর বলে। বিচারক স্থান, কাল ও পরিবেশ বিবেচনা করে অপরাধ দমনের জন্য যতটুকু শাস্তির প্রয়োজন মনে করেন ততটুকুই দিবেন। এক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব আইন প্রণয়ন করতে পারে এবং বিচারককে তা মেনে চলতে বাধ্য করতে পারে। অবস্থা অনুুযায়ী তা‘যীরকে লঘু থেকে লঘুতর, কঠোর থেকে কঠোরতর এবং ক্ষমাও করা যায়। তা‘যীরের ক্ষেত্রে ন্যায়ের অনুকূলে সুফারিশ গ্রহণ করা যায়। কিন্তু হদের বেলায় সুফারিশ করা এবং তা আমলে নেয়া কোনটিই বিধিসম্মত নয়। তা‘যীর হচ্ছে ‘সমাজের অধিকার’। যা সমাজের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে তা এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত, যেমন- রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চেচাঁমেচি করা বা রাস্তায় আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি। রাষ্ট্রই এই ধরণের অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে।
ইসলামের দন্ডবিধি :
ইসলাম চায় মানুষ নিজ থেকেই আল্লাহর ভয় এবং তাঁর প্রতি আনুগত্যের স্বাভাবিক দাবী হিসাবে অপরাধ থেকে দূরে থাকুক, আর এর ফলে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল হোক। সমাজের জনগণ আত্মশুদ্ধির স্তরে নিজেদের উন্নীত করতে ব্যর্থ হলে এবং অপরাধ সংঘটিত হলে, নির্ধারিত দন্ডবিধানই তাকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখে ও সতর্ক সাবধান করে।
হদ প্রয়োগের ক্ষেত্রসমূহঃ
ক. অবিবাহিত/বিবাহিত পুরুষ-নারীর ব্যভিচারের শাস্তিঃ
পবিত্র কুরআনে নারী ও পুরুষের চারিত্রিক পবিত্রতা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য উভয়কে পর্দা করার নির্দেশ এসেছে।
মহান আল্লাহ ব্যভিচারকে অশ্লীলতা ও নিকৃষ্ট পন্থা উল্লেখ করে এর ধারে কাছেও যেতে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً ‘তোমরা যেনা-ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেওনা। নিশ্চয় ইহা অশ্লীলতা ও নিকৃষ্ট পন্থা’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩২)।
অতঃপর মহান আল্লাহ তা‘আলা অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ব্যাভিচারের শাস্তি ১০০ চাবুকের আঘাত নির্ধারণ করেছেন। এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ‘ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের প্রত্যেককে তোমরা একশ’ বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর এই বিধান বাস্তবায়নে তাদের প্রতি যেন তোমাদের হৃদয়ে কোনরূপ দয়ার উদ্রেক না হয়; যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের এই শাস্তি প্রত্যক্ষ করে’ (নূর ২৪/০২)।
বিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যভিচার করলে তাদের শাস্তি হচ্ছে ‘রজম’ তথা পাথর মেরে হত্যা করা। যেমন হাদীছে এসেছে,
জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এলো; তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। সে বলল, সে ব্যভিচার করেছে। নবী করীম (ছাঃ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। নবী করীম (ছাঃ) যেদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, সেদিকে এসে সে লোকটি নিজের সম্পর্কে বারবার ব্যভিচারের সাক্ষ্য দিল। তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, هَلْ بِكَ جُنُونٌ তুমি কি পাগল হয়েছ? তুমি কি বিবাহিত? সে বলল, হাঁ! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ঈদগাহে নিয়ে রজম করার আদেশ দিলেন। পাথরের আঘাত যখন তাকে অতিষ্ঠ করে তুলল, তখন সে সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেল। অবশেষে তাকে হাররা নামক স্থানে ধরা হ’ল এবং হত্যা করা হ’ল’।[1]
সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদন্ড :
পুংমৈথুন বা সমকামিতা অতীতে লূত (আঃ)-এর জাতি পুংমৈথুনে অভ্যস্ত ছিল। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِنَ الْعَالَمِينَ- أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُونَ السَّبِيلَ وَتَأْتُونَ فِيْ نَادِيكُمُ الْمُنْكَرَ ‘লূতের কথা স্মরণ করুন! যখন তিনি তাঁর কওমকে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই এমন অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে আর কেউ করেনি, তোমরাই তো পুরুষে উপগত হচ্ছ, তোমরাই তো রাহাজানি করছ, তোমরাই তো ভরা মজলিসে অন্যায় কাজ করছ’ (আনকাবূত ২৯/২৮-২৯)।
পুংমৈথুনের শাস্তি হিসাবে ইসলামী শরী‘আতের পন্ডিতগণের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত হ’ল, স্বেচ্ছায় মৈথুনকারী ও মৈথুনকৃত ব্যক্তি উভয়কেই তরবারীর আঘাতে শিরচ্ছেদ করতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) সমকামিতার শাস্তি হিসেবে (যে সমকামিতা করেছে এবং যার সাথে করেছে) উভয়কে হত্যার নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) মারফূ সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, مَنْ وَجَدْتُمُوهُ يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ فَاقْتُلُوا الْفَاعِلَ وَالْمَفْعُولَ بِهِ ‘তোমরা লূতের সম্প্রদায়ের ন্যায় পুংমৈথুনের কাজ কাউকে করতে দেখলে মৈথুনকারী ও মৈথুনকৃত উভয়কেই হত্যা করবে’।[2]
মৈথুন বা সমকামিতার প্রাকৃতিক কুফলও কম নয়। এসব নির্লজ্জ বেহায়াপনার কারণেই আমাদের কালে এমন কিছু রোগ-ব্যাধি মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে যা পূর্বকালে ছিল না। বর্তমান পৃথিবীর মহাত্রাস ঘাতক ব্যাধি এইডস যার জ্বলন্ত উদাহরণ। এইডসই প্রমাণ করে যে, সমকামিতা রোধে ইসলামের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ যথার্থ হয়েছে।
খ. অপবাদ দেওয়া, সম্মান নষ্ট করা, মিথ্যা কথা প্রচার করা এবং উড়ো খবর রটানো (৮০ দোর্রা) :
সতী রমণীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তার মান-সম্মান নষ্ট করলে অপবাদদাতাকে অবশ্যই চার জন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে। নতুবা অপবাদ আরোপের শাস্তি হিসেবে ৮০টি বেত্রাঘাত প্রদান করা হবে। এ সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে- وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاء فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘আর যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেয়। অথচ চারজন (প্রত্যক্ষদর্শী) সাক্ষী হাযির করতে পারে না। তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর। আর তোমরা কখনোই তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। বস্ত্ততঃ এরাই হ’ল পাপাচারী’ (নূর ২৪/০৪)।
গ. চুরি (চোরের হাত কাটা) :
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত বিধান অনুসারে চুরির শাস্তি হাত কেটে দেওয়া। এ সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে- وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُواْ أَيْدِيَهُمَا جَزَاء بِمَا كَسَبَا نَكَالاً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের হাত কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসেবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে হুশিয়ারী। আল্লাহ পরাক্রান্ত, জ্ঞানময়’ (মায়েদাহ ৫/৩৮)।
চুরির শাস্তি সম্পর্কে হাদীছে এসেছে- عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ أُسَامَةَ، كَلَّمَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِي امْرَأَةٍ فَقَالَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا يُقِيمُونَ الْحَدَّ عَلَى الْوَضِيعِ، وَيَتْرُكُونَ الشَّرِيفَ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ فَاطِمَةُ فَعَلَتْ ذَلِكَ لَقَطَعْتُ يَدَهَا আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, উসামা (রাঃ) জনৈক মহিলার ব্যাপারে নাবী (ছাঃ)-এর কাছে সুফারিশ করলেন। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কারণ তারা আতরাফ (নিম্নশ্রেনীর) লোকদের উপর শরী‘আতের শাস্তি কায়েম করত। আর শরীফ লোকদেরকে রেহাই দিত। ঐ মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার জান, ফাতিমাও যদি এ কাজ করত, তাহ’লে অবশ্যই আমি তারও হাত কেটে দিতাম।[3]
ঘ. মদ পান করা এবং নেশা করা (৪০ দোর্রা) :
নেশাদার দ্রব্য ও মদ পান সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ভাষ্য-
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَآ أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبيِّنُ اللّهُ لَكُمُ الآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ-
‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। তুমি বল, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং উপকারও আছে মানুষের জন্য, তবে এদের পাপ উপকারের চেয়ে অধিক’ (বাকারা-২/২১৯)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্রে বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন ছালাতের ধারে-কাছেও যেওনা, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ’ (নিসা ৪/৪৩)।
তিনি আরো বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! মদ, জুয়া, মুর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ণায়ক তীর তো ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা সব বর্জন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (মায়েদাহ ৫/৯০)।
তিনি আরো বলেন, إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللّهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ- ‘শয়তান তো তোমাদের মাঝে শক্রতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে এবং তোমাদের বাধা দিতে চায় আল্লাহর স্মরণ থেকে ও ছালাত থেকে। তবুও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না? (মায়িদা-৫/৯১)।
মদ পানের ভয়াবহতা সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ)-এর সতর্কবাণী :
মদ পান করা অবস্থায় মদ পানকারী কোন মুসলিমের ঈমান থাকেনা। অতএব যদি এ অবস্থায় মৃত্যু এসে যায় তাহ’লে তাকে বেঈমান হয়ে মরতে হবে। কেননা হাদীছে এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ وَهْوَ مُؤْمِنٌوَعَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ، وَأَبِي، سَلَمَةَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم بِمِثْلِهِ، إِلاَّ
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, কোন ব্যভিচারী ব্যভিচার করার সময় মুমিন থাকে না। কোন মদ পানকারী মদ পান করার সময় মুমিন থাকে না। কোন চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না এবং কোন ছিনতাইকারী এমনভাবে ছিনতাই করে যে, মানুষ তা দেখার জন্য তাদের চোখ সেদিকে উত্তোলিত করে; তখন সে মুমিন থাকে না’।[4] ‘নবী করীম (ছাঃ) মদ পানকারীকে বেত্রাঘাত এবং জুতা মেরেছেন এবং আবু বকর (রাঃ) মদপানকারীকে ৪০টি বেত্রাঘাত করেছেন।[5]
সাঈদ ইবনু ইয়াযীদ বলেছেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর সময়ে এবং হযরত আবু বকর ও ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে আমাদের সামনে মাতালকে উপস্থিত করা হ’লে আমরা তাকে হাত, জুতা ও চাদর দিয়ে মারতাম। হযরত ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতের শেষের দিকে ৪০টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করা হয় এবং সীমালংঘনকারী ফাসিকদের জন্য ৮০টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন’। হাদীছে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনকারীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার জন্য হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, কেউ মাতাল হলে তাকে বেত্রাঘাত কর। সে পুনরায় মাতাল হলে তাকে বেত্রাঘাত কর। সে পুনরায় মাতাল হলে আবারো বেত্রাঘাত কর। এরপর চতুর্থবার বলেছেন, সে যদি পুনরায় মাতাল হয়, তাহলে তার গর্দান উড়িয়ে দাও’।[6]
ঙ. যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কর্তৃক যুদ্ধের ঘোষণা :
খলীফা আবু বকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে যাকাত অস্বীকারকারীদের ঘটনা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে-
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আবূ বকর (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় আরবের কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যায়। তখন উমার (রাঃ) [আবূ বকর (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে] বললেন, আপনি (সে সব) লোকদের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করবেন (যারা সম্পূর্ণ ধর্ম পরিত্যাগ করেনি বরং যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে মাত্র)? অথচ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে, যে কেউ তা বলল, সে তার সম্পদ ও জীবন আমার পক্ষ থেকে নিরাপদ করে নিল। তবে ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করলে (শাস্তি দেয়া যাবে), আর তার অন্তরের গভীর (হৃদয়াভ্যন্তরে কুফরী বা পাপ লুকানো থাকলে এর) হিসাব-নিকাশ আল্লাহর যিম্মায়।
আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আললাহর শপথ! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধ করব যারা ছালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, কেননা যাকাত হ’ল সম্পদের উপর আরোপিত হক্ব। আল্লাহর কসম! যদি তারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায় যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে তারা দিত, তাহলে যাকাত না দেয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব। উমার (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ আবূ বকর (রাঃ)-এর হৃদয়ে বিশেষ জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেছেন বিধায় তাঁর এ দৃঢ়তা, এতে আমি বুঝতে পারলাম তাঁর সিদ্ধান্তই যথার্থ’।[7] মহান আল্লাহর বাণী, فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ- ‘যদি তারা তওবা করে এবং ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত প্রদান করে তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই’ (তওবা ৯/১১)।
হাদীছে এসেছে, عَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ بَايَعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى إِقَامِ الصَّلاَةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ، وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-এর নিকট ছালাত কায়েম করা, যাকাত দেয়া ও সকল মুসলিমের কল্যাণ কামনা করার উপর বায়‘আত করি’।[8]
চ. মুরতাদ বা কোন ব্যক্তির ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার শাস্তি মৃত্যুদন্ড :
আল্লাহর বাণী, إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا- ‘যারা ঈমান আনে, পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান এনে আবার কুফরী করে, এরপর তাদের কুফরী প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদের কোন পথও দেখাবেন না’ (নিসা ৪/১৩৭)।
আল্লাহ বলেন,مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ- ‘তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন হতে ফিরে গেলে আল্লাহ এমন এক জাতি আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন ও যারা তাঁকে ভালবাসবে’ (মায়েদাহ ৫/৫৪)।
আল্লাহ বলেন, مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ - ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ ‘যার উপরে (কুফরীর জন্য) যবরদস্তি করা হয়, অথচ তার হৃদয় ঈমানের উপর অটল থাকে, সে ব্যতীত যে ব্যক্তি ঈমান আনার পরে কুফরী করে এবং কুফরীর জন্য হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেয়, তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব ও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। এটা এজন্য যে, তারা পার্থিব জীবনকে পরকালীন জীবনের উপরে অগ্রাধিকার দেয়। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (নাহল ১৬/১০৬-১০৭)।
আল্লাহ অন্যত্রে বলেন,وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ- ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ স্বীয় দ্বীন হতে ফিরে যায় ও কাফির হয়ে মারা যায়, ইহকাল ও পরকালে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। এরাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)।
ইকরিমাহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আলী (রাঃ)-এর কাছে একদল যিন্দীককে (নাস্তিক ও ধর্মত্যাগীকে) আনা হল। তিনি তাদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। এ ঘটনা ইবনু আববাস (রাঃ)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, ‘আমি কিন্তু তাদেরকে পুড়িয়ে ফেলতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা আছে যে, তোমরা আল্লাহর শাস্তি দ্বারা শাস্তি দিও না। বরং আমি তাদেরকে হত্যা করতাম। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ আছে, যে কেউ তার দ্বীন বদলে ফেলে তাকে তোমরা হত্যা কর’।[9]
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গালিদাতার শাস্তি মৃত্যুদন্ড :
শরী‘আতের দৃষ্টিতে রাসূল (ছাঃ)-কে গালিদাতা ব্যক্তি হত্যাযোগ্য অপরাধী। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছেন’।[10] ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গালি দিত। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।[11] জনৈকা ইহূদী মহিলা রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিত। তখন একজন মুসলিম তাকে হত্যা করলে রাসূল (ছাঃ) তার রক্তমূল্য দেননি’।[12]
জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিত। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, কে আমার এই শত্রুকে হত্যা করবে? খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, আমি। তখন খালেদ (রাঃ)-কে পাঠানো হয় এবং তিনি তাকে হত্যা করেন’।[13] একবার দুজন মহিলা গানের মাধ্যমে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিন্দা করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন’।[14]
তবে এই হুকুম বাস্তবায়ন করবে দেশের সরকার বা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। এক্ষণে কোন মুসলিম যদি ব্যক্তিগতভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর গালিদাতাকে হত্যা করে ফেলে এবং সেটা আদালতে প্রমাণিত হয়, তাহলে আদালত তাকে শাস্তি দিবে না। কারণ রাসূল (ছাঃ) গালিদাতার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।[15]
(ক্রমশঃ)
[1]. আহমাদ হা/১৪৪৬৯; বুখারী হা/৫২৭০।
[2]. মিশকাত হা/৩৫৭৫।
[3]. বুখারী হা/২৮৩১।
[4]. বুখারী হা/৬৩১৫; মুসলিম হা/৫৭; তিরমিযী হা/২৬২৫।
[5]. বুখারী হা/৬৩১৭।
[6]. ইবনে মাজাহা হা/২৫৭২।
[7]. বুখারী হা/১৩৯৯; ১৪০০।
[8]. বুখারী হা/১৪০১।
[9]. বুখারী হা/৬৯২২।
[10]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ১২ আয়াত ৮/৮২; বিস্তারিত দ্র. ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ), আছ-ছারেমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল (ছাঃ)।
[11]. বুখারী হা/২৫১০; মুসলিম হা/১৮০১।
[12]. আবুদাউদ হা/৪৩৬২; মিশকাত হা/৩৫৫০; ইরওয়া হা/১২৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[13]. মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৫/২৩৭; মুহাল্লা ১২/৪৩৭।
[14]. যাদুল মা ’আদ ৩/৩৮৬ পৃঃ।
[15]. আবুদাউদ হা/৪৩৬১; ৪৩৬২; মিশকাত হা/৩৫৫০; ইরওয়া হা/১২৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।