মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতি ঈমান (৫ম কিস্তি)

আসাদুল্লাহ আল-গালিব 4923 বার পঠিত

 পর্ব ২ |  পর্ব ৩ | পর্ব ৪ 

البعث (পুনরুত্থান) :

পুনরুত্থান একটি অবশ্যসভাবী ও আক্বীদাগত বিষয়। জীবন লাভের পর যে মৃত্যুবরণ করেছে তার পুনরুত্থান ঘটবেই। ইবনু হাযার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘البعث হ’ল মৃত্যুর পরের জীবন, যা কবর থেকে বের হওয়ার মাধ্যমে সংঘটিত  হবে’।[1] মৃত্যুর পর বারযাখী তথা কবরের জীবন শেষে রূহ-শরীরের সংযোগে পূর্ব অবয়বে উত্থিত হওয়া। সেই দিন জীব-জন্তুর বিচার ফায়ছালার পর তারা মাটিতে পরিণত হবে। তারপর মানবকুলের হিসাব-নিকাশ শুরু হবে। আর এতে বিশ্বাস রাখা ঈমানের একটি শাখা, যা প্রত্যেক মুমিনের জন্য যরূরী। পবিত্র কুরআনে কয়েকটি শব্দে পুনরুত্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন-

(১) المعاد (উৎপত্তি স্থল) :

মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِي فَرَضَ عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لَرَادُّكَ إِلَى مَعَادٍ ‘নিশ্চয়ই যিনি তোমার উপর কুরআনকে (অর্থাৎ তার প্রচার ও অনুসরণকে) ফরয করেছেন। তিনি অবশ্যই তোমাকে তোমার উৎপত্তিস্থলে ফিরিয়ে আনবেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৫)

(২) النُّشُورُ (পুনরুত্থান) :

মহান আল্লাহ বলেন, وَاللَّهُ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَسُقْنَاهُ إِلَى بَلَدٍ مَيِّتٍ فَأَحْيَيْنَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا كَذَلِكَ النُّشُورُ ‘আল্লাহই বায়ু প্রবাহিত করেন। অতঃপর তা মেঘমালা সঞ্চার করে। অতঃপর আমরা তাকে মৃত ভূখন্ডের দিকে পরিচালিত করি। অতঃপর তদ্বারা ঐ ভূখন্ডকে তার মৃত্যুর পরে জীবিত করি। এভাবেই হবে (তোমাদের) পুনরুত্থান’ (ফাতির ৩৫/৯)

(৩) الْخُرُوجُ (উত্থান ঘটা বা বহির্গত হওয়া) :

মহান আল্লাহ বলেন, وَأَحْيَيْنَا بِهِ بَلْدَةً مَيْتًا كَذَلِكَ الْخُرُوجُ ‘আর আমি পানি দ্বারা মৃত শহর সঞ্জীবিত করি। এভাবেই উত্থান ঘটবে’ (ক্বফ ৫০/১১)

পুনরুত্থানের পূর্বে সকল কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটবে শুধুমাত্র আল্লাহ অবশিষ্ট থাকবেন (রহমান ৫৫/২৭)। তারপর সবকিছুরই পুনর্জন্ম ঘটবে। নিম্নে সেগুলোর বর্ণনা করা হলো।

জীবের জীবন লাভ :

দুনিয়ার প্রতিটি জীব যারা বসবাস করেছিল তারা পুনরায় জীবন লাভ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قُلْتُمْ يَامُوسَى لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ- ثُمَّ بَعَثْنَاكُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ- ‘আর যখন তোমরা বলেছিলে হে মূসা! আমরা কখনোই তোমার উপরে বিশবাস স্থাপন করব না, যতক্ষণ না আল্লাহকে আমরা প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন বজ্র তোমাদের পাকড়াও করল, যা তোমরা প্রত্যক্ষ করেছিলে’। ‘অতঃপর আমরা তোমাদের পুনর্জীবিত করলাম তোমাদের মৃত্যুর পর। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬)

আসমানের পুনর্সৃষ্টি :

মহান আল্লাহ বলেন, أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ بَلَى وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ ‘যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি তাদের মত মানুষকে সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হ্যঁা (অবশ্যই সক্ষম)। তিনি মহা স্রষ্টা ও সর্বজ্ঞ’ (ইয়াসীন ৩৬/৮১)

মৃত পৃথিবীর পুনর্জন্ম :

মহান আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ حَتَّى إِذَا أَقَلَّتْ سَحَابًا ثِقَالًا سُقْنَاهُ لِبَلَدٍ مَيِّتٍ فَأَنْزَلْنَا بِهِ الْمَاءَ فَأَخْرَجْنَا بِهِ مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ كَذَلِكَ نُخْرِجُ الْمَوْتَى لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ‘তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী হিসাবে বায়ু প্রবাহ প্রেরণ করেন। অবশেষে যখন ঐ বায়ুরাশি পানিপূর্ণ মেঘমালাকে বহন করে আনে, তখন আমরা তাকে কোন নির্জীব ভূখন্ডের দিকে হঁাকিয়ে নেই। অতঃপর ওটা থেকে বারি বর্ষণ করি। অতঃপর তার মাধ্যমে সকল প্রকার ফল-ফলাদি উৎপন্ন করি। এভাবেই আমরা (ক্বিয়ামতের দিন) মৃতদের জীবিত করব। এ থেকে সম্ভবতঃ তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে’ (আ‘রাফ ৭/৫৭)

পুনরুত্থান সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) থেকেও বেশ কিছু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بَارِزًا يَوْمًا لِلنَّاسِ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ مَا الإِيمَانُ قَالَ الإِيمَانُ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَبِلِقَائِهِ وَرُسُلِهِ وَتُؤْمِنَ بِالْبَعْثِ- ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌[2]

অপর হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهم قَالَ بَيْنَمَا رَجُلٌ وَاقِفٌ بِعَرَفَةَ إِذْ وَقَعَ عَنْ رَاحِلَتِهِ فَوَقَصَتْهُ أَوْ قَالَ فَأَوْقَصَتْهُ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اغْسِلُوهُ بِمَاءٍ وَسِدْرٍ وَكَفِّنُوهُ فِى ثَوْبَيْنِ وَلاَ تُحَنِّطُوهُ وَلاَ تُخَمِّرُوا رَأْسَهُ فَإِنَّهُ يُبْعَثُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مُلَبِّيًا- ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌[3]

ইস্রাফীল (আঃ) যখন সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন তখন সকলেই কবর হতে দ্রুত বের হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ ‘আর যখন শিঙ্গায় ফঁুকে দেওয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে উঠে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে আসবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৫১)

আর পুনরুত্থান সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ثُمَّ يُنْزِلُ اللهُ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَيَنْبُتُونَ كَمَا يَنْبُتُ الْبَقْلُ لَيْسَ مِنَ الإِنْسَانِ شَىْءٌ إِلاَّ يَبْلَى إِلاَّ عَظْمًا وَاحِدًا وَهْوَ عَجْبُ الذَّنَبِ وَمِنْهُ يُرَكَّبُ الْخَلْقُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘এরপর আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করবেন। এতে মৃতরা জীবিত হয়ে উঠবে, যেমনি বৃষ্টির পানিতে উদ্ভিদরাজি উৎপন্ন হয়। তখন মেরুদন্ডের হাড় ছাড়া মানুষের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পচে গলে শেষ হয়ে যাবে। কিয়ামতের দিন ঐ হাড়-খন্ড থেকেই পুনরায় মানুষকে সৃষ্টি করা হবে’।[4] 

পূর্বাকৃতিতে প্রত্যাবর্তন :

মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ ‘তুমি বলে দাও, ঐগুলিকে তিনিই জীবিত করবেন যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর তিনি প্রত্যেক সৃষ্টি সম্পর্কে সুবিজ্ঞ’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৯)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الَّذِي يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনিই এর পুনরাবৃত্তি করবেন। আর এটা তঁার জন্য খুবই সহজ, বস্ত্ততঃ আকাশ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তঁারই, তিনি মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (রূম ৩০/২৭)

পুনরুত্থানে অস্বীকারকারীদের পরিণাম :

পুনরুত্থানে অস্বীকার করা কুফুরী। যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে সে কাফের। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنْ تَعْجَبْ فَعَجَبٌ قَوْلُهُمْ أَإِذَا كُنَّا تُرَابًا أَإِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ‘যদি তুমি বিস্মিত হও, তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হ’ল তাদের এই কথা যে, যখন আমরা মরে মাটি হয়ে যাব, তখনও কি ফের নতুনভাবে সৃষ্ট হব? ওরা ওদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছে। আর ওদেরই গলদেশে থাকবে লোহার বেড়ী। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (রা‘দ ১৩/৫)

মূলতঃ মক্কার কাফেররা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত।[5]  সাথে সাথে গ্রীক ও হিন্দুস্তানীরাও একই মত পোষণ করত।[6] তাদের বিশ্বাসকে রদ করে মহান আল্লাহ বলেন, زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ لَنْ يُبْعَثُوا قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ ‘কাফিররা ধারণা করেছিল যে, তারা কখনোই পুনরুত্থিত হবে না। বল, ‘হ্যাঁ, আমার রবের শপথ, তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে, অতঃপর তোমরা যা আমল করেছিলে তা অবশ্যই তোমাদের জানানো হবে। আর এটি আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ’ (তাগাবুন ৬৪/৭)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ- قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ- الَّذِي جَعَلَ لَكُمْ مِنَ الشَّجَرِ الْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَا أَنْتُمْ مِنْهُ تُوقِدُونَ- أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ بَلَى وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ- إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ-فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-  ‘আর সে আমাদের সম্পর্কে নানাবিধ উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টি বিষয়ে ভুলে যায়। সে বলে, হাড্ডিগুলিকে যে জীবিত করবে যখন তা পচে-গলে যাবে? ‘তুমি বলে দাও, ঐগুলিকে তিনিই জীবিত করবেন যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর তিনি প্রত্যেক সৃষ্টি সম্পর্কে সুবিজ্ঞ’। ‘যিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে অগ্নি উৎপাদন করেন। অতঃপর তোমরা তা থেকে আগুন জ্বালিয়ে থাক’। ‘যখন তিনি কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন তাকে কেবল বলে দেন, হও। অতঃপর তা হয়ে যায়’। ‘অতএব (সকল প্রকার শরীক হ’তে) মহা পবিত্র তিনি, যার হাতে রয়েছে সবকিছুর রাজত্ব এবং তঁার দিকেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৮-৮৩)

الحشر )হাশর( :

হাশর আরবী শব্দ যার অর্থ হলো সমাবেশ, ভীড়’।[7] আর এটা ক্বিয়ামতের দিন সংঘটিত হবে’।[8] পারিভাষিক অর্থ হ’ল, ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির একটি সমাবেশস্থলে একত্রিত হওয়াকে হাশর বলে।

হাশর সম্পর্কে মহান আল্লাহর বলেন, وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا ‘আমরা তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন সমবেত করব মুখের উপর ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, বোবা ও বধির করে। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যখনই তা স্তিমিত হবে, তখনই আমরা তাদের জন্য অগ্নি বৃদ্ধি করে দেব’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৯৭)

হাশর সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, عَنِ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم  تُحْشَرُونَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلاً  قَالَتْ عَائِشَةُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ فَقَالَ الأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يُهِمَّهُمْ ذَاكِ- আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মানুষকে হাশরের ময়দানে উঠানো হবে খালি পা, উলঙ্গ ও খাতনাবিহীন অবস্থায়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তো পুরুষ ও নারীগণ একে অপরের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে। তিনি বললেন, এইরূপ ইচ্ছা করার চাইতেও কঠিন হবে তখনকার অবস্থা’।[9]

অপর হাদীছে বলা হয়েছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خَطِيبًا بِمَوْعِظَةٍ فَقَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّكُمْ تُحْشَرُونَ إِلَى اللَّهِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلاً (كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ) أَلاَ وَإِنَّ أَوَّلَ الْخَلاَئِقِ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ- ‘ইবন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, উপদেশ সম্বলিত ভাষণ দানের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)  আমাদের মাঝে দন্ডায়মান হয়ে বললেন, হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর সামনে খালি পা এবং নগ্নদেহ অবস্থায় উপস্থিত হবে। যেমন প্রথম দিন শুরু করেছিলাম, তেমনি তার পুনরাবৃত্তি করবো। এটা আমার একটা ওয়াদা, তা পালন করা আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আমি তা পালন করবই। সাবধান, ক্বিয়ামতের দিন সবার মাঝে সর্বপ্রথম ইবরাহীম (আঃ)-কে পোশাক পরানো হবে’।[10] 

হাশরের ময়দান :

মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ وَبَرَزُوا لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ‘যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং পরিবর্তিত হবে আকাশমন্ডলী। আর মানুষ মহা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে’ (ইবরাহীম ১৪/৪৮)

হাদীছে এসেছে,عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى أَرْضٍ بَيْضَاءَ عَفْرَاءَ كَقُرْصَةِ نَقِىٍّ قَالَ سَهْلٌ أَوْ غَيْرُهُ لَيْسَ فِيهَا مَعْلَمٌ لأَحَدٍ- সাহল ইবন সাঈদ (রা) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ক্বিয়ামতের দিন মানুষকে এমন স্বচ্ছ শুভ্র সমতল যমীনের উপর একত্রিত করা হবে যেমন সাদা গমের রুটি স্বচ্ছ-শুভ্র হয়ে থাকে। সাহল বা অন্য কেউ বলেছেন, তার মাঝে কারও কোন কিছুর চিহ্ন বিদ্যমান থাকবে না’।[11]

হাশরের ময়দানে সৃষ্টিজীবের অবস্থা :

(১) কাফেরদের অবস্থা :

হাশরের ময়দানে কাফেররা তাদের মুখের উপর ভর করে উপস্থিত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِهِ وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا ‘আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, সেই-ই সুপথ প্রাপ্ত হয়। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তাদের জন্য তঁাকে ব্যতীত কাউকে বন্ধু হিসাবে পাবে না। আমরা তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন সমবেত করব মুখের উপর ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, বোবা ও বধির করে। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যখনই তা স্তিমিত হবে, তখনই আমরা তাদের জন্য অগ্নি বৃদ্ধি করে দেব’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৯৭)। আর সেদিন মন্দ পিপাসার্ত লোকদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَنَسُوقُ الْمُجْرِمِينَ إِلَى جَهَنَّمَ وِرْدًا ‘আর পাপীদেরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হঁাকিয়ে নেব’ (মারিয়াম ১৯/৮৬)

(২) অহংকারী ব্যক্তির অবস্থা :

অহংকারী ব্যক্তিরা হাশরের ময়দানে উপস্থিত হ’লে অপমান-লাঞ্ছনা তাদেরকে ঘিরে রাখবে। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِى صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِى جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُولَسَ تَعْلُوهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ الْخَبَالِ. ‘ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে মানুষের আকৃতিতে পিপীলিকার ন্যায় একত্রিত করা হবে। সব দিক থেকে লাঞ্চনা তাদেরকে আচ্ছাদিত করে ফেলবে। জাহান্নামের ‘বূলাস’ নামীয় বন্দীখানায় তাদের হঁাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কঠিন অগ্নি তাদের গ্রাস নিবে। জাহান্নামীদের পূতিগন্ধময় পূঁজ-রক্ত ইত্যাদি তাদের পান করানো হবে’।[12] 

(৩) মুত্তাকী ব্যক্তিদের অবস্থা :

মুত্তাকীরা সেই দিন সম্মানের সাথে জান্নাতের মেহমানরূপে উপস্থিত হবেন। মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ نَحْشُرُ الْمُتَّقِينَ إِلَى الرَّحْمَنِ وَفْدًا ‘সেদিন আমরা আল্লাহভীরুদেরকে দয়াময়ের নিকট মেহমানরূপে সমবেত করব’ (মারিয়াম ১৯/৮৫)

(৪) পশু-পাখি, চতুষ্পদ জন্তুর উপস্থিতি :

এবিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ ‘যেদিন বন্যপশুদের একত্রিত করা হবে’ (তাকভীর ৮১/৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল সকল প্রাণী এবং দু’ডানায় ভর করে আকাশে সন্তরণশীল সকল পাখি তোমাদেরই মত একেকটি সম্প্রদায়। (তাদের হেদায়াতের বিষয়ে) কোন কিছুই আমরা এই কিতাবে বলতে ছাড়িনি। অতঃপর তাদের সকলকে তাদের প্রতিপালকের কাছে সমবেত করা হবে’ (আন‘আম ৬/৩৮)

(ক্রমশঃ)

[লেখক : ৪র্থ বর্ষ, দাওয়া এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া ও সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া শাখা]   


[1]. ফাৎহুল বারী ১১/৩৯৩ পৃ.।

[2]. বুখারী হা/৫০।

[3]. বুখারী হা/১২৬৫।

[4]. বুখারী হা/৪৯৩৫।

[5]. আল-মিলাল ওয়ান নাহাল ২/২৪০ পৃ.।

[6]. আল জাওয়াবুছ ছহীহ লিমান বাদ্দালা দ্বীনাল মাসীহ ৬/১১পৃ.।

[7]. ড. ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (ঢাকা : ৪র্থ সংস্করণ, ২০০৭), ৩৩৯ পৃ.।

[8]. আল-মুফরাদাত ১২০ পৃ.।

[9]. বুখারী হা/৬৫২৭।

[10]. মুসলিম হা/২৮৬০ (৫৮)।

[11]. বুখারী হা/৬৫২১।

[12]. তিরমিযী হা/২৪৯২।



বিষয়সমূহ: আক্বীদা
আরও